মৃত্যুর প্রহর বড়ই কঠিন! মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে কারাগারে হাজারেরও বেশি কয়েদির দুর্বিষহ জীবন

ঢাকা টাইমস্‌ ডেস্ক ॥ মৃত্যুর প্রহর গোনা মানুষের জীবনটা কেমন হতে পারে তা একমাত্র সেই ব্যক্তিই যানে, যে এই মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ফাঁসির আদেশ হয়েছে অথচ মামলার জটের কারণে মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে কারাগারে এমন হাজারেরও বেশি কয়েদি দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করছে।

আমরা ইতিপূর্বেও এমন সংবাদ করেছি। দেশের কারগারগুলো এমনিতেই জায়গা স্বল্পতার কারণে কয়েদিদের বসবাস বড়ই কঠিন। তারওপর যেসব আসামী মৃত্যুদণ্ড ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, নিশ্চিত মৃত্যু যেনে তাদের দিনাতিপাত একটি কঠিন ও কঠোর বিষয়। তাছাড়া কিছু আসামী আছে যারা উচ্চ আদালতে গিয়ে হয়তো নির্দোশ প্রমাণিত হয়ে বেরিয়ে আসতে পারতেন কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে হচ্ছে না। জানা গেছে, নিম্ন আদালতের রায়ে তারা ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় দ্রুত বিচার আদালতে দণ্ডিত নুরুল ইসলাম সরকারের আপিল ৭ বছর ধরে হাইকোর্টে ঝুলে আছে। সাধারণত আসামিরা মামলার শুনানিতে কালক্ষেপণ করে, আদালতের ওপর অনাস্থা জ্ঞাপন করে থাকে। এক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো। বাদীপক্ষ এ পর্যন্ত ৭টি বেঞ্চের ওপর অনাস্থা জানানোর ফলে এ মামলা নিষ্পতি হচ্ছে না। ফাঁসির সেলে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ধুঁকছেন নির্দোষ দাবিদার নুরুল ইসলাম সরকার। অপর দু’জনের আপিলের শুনানি এখনও শুরুই হয়নি।

একই দণ্ড মাথায় নিয়ে এখন কারাগারের কনডেম সেলে প্রায় এক হাজারের বেশি বন্দি দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন। কারাগারের কনডেম সেলে একশ’রও কম সংখ্যক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ধারণ ক্ষমতা থাকলেও সেখানে রাখা হচ্ছে হাজারের অধিক। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বর্তমানে ১১০ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আপিলের ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজন নারীও রয়েছেন। কেন্দ্রীয় কারাগারের শাপলা ফাঁসির সেলে ৩, হাসনাহেনায় ৬৯, রজনীগন্ধায় ৩৩ ও আলাদা কক্ষে পাঁচ নারী রয়েছেন।

ছোট্ট সেলে অনেকটা গাদাগাদি করেই থাকতে হচ্ছে তাদের। এসব কক্ষে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস নেই। গোসল ও টয়লেট সুবিধাও নাজুক। চিকিৎসার জন্য রয়েছে নামেমাত্র ব্যবস্থা। খাবারের পরিমাণ যেমন কম, মান তেমনি জঘন্য। দীর্ঘদিন কারাবাসে থাকায় অনেককে বাধ্য হয়ে খেতে হচ্ছে রাষ্ট্রের দেয়া নিম্নমানের খাবার। এমন পরিবেশেই বছরের পর বছর ধরে থাকতে হচ্ছে বন্দিদের। এতে তাদের মানবাধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা। তারা এটি জেলকোডের ন্যূনতম মানদণ্ডের লঙ্ঘন উল্লেখ করে সরকারের কাছে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ দেয়া ও এ ব্যবস্থা পরিবর্তনে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্‌বান জানান। তবে আইজি প্রিজনের দাবি, জেল কোড অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৫ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির জন্য ৭৯১টি মামলা এলেও নিষ্পত্তি হয় ২৭০টি মামলা। এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা এসব মামলা নিষ্পত্তি সময় একটা নির্দিষ্ট ফ্রেমের মধ্যে নিয়ে আসা উচিত বলে মত দেন। তারা মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার জন্য, বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্সের পেপারবুক তৈরিতে দীর্ঘ সময় নেয়া, প্রয়োজনীয় রেকর্ড না আসা, নিষ্পত্তির জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বেঞ্চ না থাকা, সিনিয়র ও দক্ষ বিচারপতিদের কাঙ্খিত বেঞ্চ না দেয়া, বেঞ্চ ভেঙে যাওয়া, রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবীদের অদক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেন। বিচারের ক্ষেত্রে গতিশীলতা আনতে বেঞ্চ বাড়ানো ও দ্রুত পেপারবুক তৈরির ওপর জোর দেন আইনজ্ঞরা। বলেন, ডেথ রেফারেন্সের বিচারের জন্য প্রথম শর্ত পেপারবুক তৈরি করা। কিন্তু বিজি প্রেস থেকে যথাসময়ে পেপারবুক তৈরি হয়ে না আসায় এ ধরনের মামলার শুনানি করা যায় না। অনেক সময় প্রয়োজনীয় রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায় না।

তারা এসব মামলার নিষ্পত্তি করতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনে হাইকোর্ট রুলস্‌ে নতুন বিধান সংযোজন করা যেতে পারে বলে মত দেন। আইন অনুযায়ী বিচারিক আদালতে দেয়া সাজা কার্যকর করতে হলে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন প্রয়োজন। কোনো আসামি নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করলেও রাষ্ট্রপক্ষ থেকেই এসব মামলার আপিলের উদ্যোগ নিয়ে নিষ্পত্তি করতে হয়। নিম্ন আদালত রায় ঘোষণার পর এ সংক্রান্ত নথিপত্র উচ্চ আদালতে পাঠানো হয় ওই রায় অনুমোদনের জন্য, যা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে পরিচিত।

ডেথ রেফারেন্স বিভাগ সূত্র জানায়, ২০০৩ সালে ৬৬টি ডেথ রেফারেন্স মামলা হাইকোর্টে আসে। এছাড়া ২০০৪ সালে ১৭৬টি, ২০০৫ সালে ১৭৫টি, ২০০৬ সালে ১১২টি, ২০০৭ সালে ১০২টি, ২০০৮ সালে ১৩৭টি, ২০০৯ সালে ৮৩টি, ২০১০ সালে ৭৬টি, ২০১১ সালে ৬৭টি এবং চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আসে ৩৩টি। এদের মধ্যে ২০০৩ সালে ৪৫টি ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হয়। এছাড়া ২০০৪ সালে ১০০টি, ২০০৫ সালে ৪৫টি, ২০০৬ সালে ৬৪টি, ২০০৭ সালে ৪৮টি, ২০০৮ সালে ১২৮টি, ২০০৯ সালে ৪৮টি, ২০১০ সালে ৪৩টি, ২০১১ সালে ৭৪টি মামলার নিষ্পত্তি হয়।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এডুকেশন ও হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগ্যাল কমিটির চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা খান বলেন, এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজনে নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। বিচারের পর নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে অনেকে মুক্তি পাচ্ছেন। রাষ্ট্রের উচিত তাদের প্রতি মানবিক ও সদয় হওয়া। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, কনডেম সেলে বন্দিদের অমানবিক জীবনযাপন মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যারা নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছেন রাষ্ট্রের কর্তব্য তাদের ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ দেয়া। তিনি বলেন, বিচারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একজন মানুষের জীবন থেকে কয়েক বছর চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। সরকারকে এ বিষয়টির দিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে।

তবে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রারের দাবি, বর্তমান সময়ে ডেথ রেফারেন্স শুনানির গতি বেড়েছে। অনেক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে।

Related Post

সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার একেএম শামসুল ইসলাম বলেন, মামলার জট কমাতে এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। এ ধারাবাহিতকতা বজায় থাকলে সামনে অবস্থার আরও উন্নতি হবে।

তবে কথা যতই হোক সব কথার শেষ কথা আইন যাতে তার গতি স্বাভাবিক রাখে সে দায়িত্ব সরকারের। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অবশ্যই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে কাওকেই যেনো বিচারের অপেক্ষায় বছরের পর বছর দুর্বিষহ জীবন কাটাতে না হয়। কেও দোষী হলে তার বিচার হবে সেটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু যে নির্দোশ সে কেনো বছরের পর বছর সাজা ভোগ করবেন? এ প্রশ্ন প্রতিটি বিবেকবান মানুষের।

This post was last modified on আগস্ট ১৮, ২০১২ 12:15 পূর্বাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার

View Comments

  • I wanted to draft you this very small note to give thanks over again considering the superb opinions you've shared in this case. This has been simply generous of people like you to provide easily precisely what most of us would've marketed for an electronic book to make some profit on their own, notably now that you could have tried it if you ever decided. The advice additionally acted to be the great way to know that some people have similar desire just like mine to find out a great deal more in respect of this issue. I know there are millions of more pleasurable occasions in the future for individuals that look over your site.

  • Undeniably believe that which you stated. Your favorite reason appeared to be on the internet the simplest thing to be aware of. I say to you, I definitely get annoyed while people think about worries that they plainly do not know about. You managed to hit the nail upon the top and also defined out the whole thing without having side-effects , people could take a signal. Will probably be back to get more. Thanks

Recent Posts

মার্কিন পতাকা নামিয়ে ফিলিস্তিনি পতাকা উড়লো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলমান ক্যাম্পাস বিক্ষোভের…

% দিন আগে

বাংলা সাল যেভাবে এলো

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বৈশাখ এলে বাংলা সালের কথা আমাদের মনে পড়ে। আসলে এই…

% দিন আগে

নদী ও নৌকা: এক অসাধারণ গ্রামের দৃশ্য

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ শুভ সকাল। মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪ খৃস্টাব্দ, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১…

% দিন আগে

আপনি কী জনেন দিবানিদ্রার অভ্যাসে বাড়তে পারে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি!

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ দিনের বেলায় ঘুমানোকে আমরা ভাত ঘুম বলে থাকি। তবে দিনের…

% দিন আগে

ডিপিএস এসটিএস স্কুল ঢাকার ২০২৩-২৪ সেশনের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ডিপিএস এসটিএস সিনিয়র স্কুল অডিটোরিয়ামে আয়োজিত হয়েছে ডিপিএস এসটিএস স্কুল…

% দিন আগে

এসসিবি-চ্যানেল আই অ্যাগ্রো অ্যাওয়ার্ড ২০২৩: ‘সেরা কৃষি প্রতিষ্ঠান’ স্বীকৃতি পেলো আইফার্মার

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক অ্যান্ড চ্যানেল আই অ্যাগ্রো অ্যাওয়ার্ড ২০২৩- এর…

% দিন আগে