থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে মানবদেহের কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ

দি ঢাকা টাইমস্‌ ডেস্ক ॥ একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আবিস্কার সম্ভবত থ্রিডি প্রিন্টিং মেশিন। এই বহুল পরিচিত মেশিনটি দিয়ে এতদিন স্থাপত্য, পোশাক শিল্পে, প্রকৌশল এবং প্রযুক্তিগত কাজেই বেশি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার দিনকে দিন বাড়ছে।


প্রথমদিকে থ্রিডি প্রিন্টারের উৎপত্তি হওয়ার পর পর এর ব্যবহার ছিল শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত দিকে, বিশেষ করে স্পর্শকাতর চিপ তৈরি, আইসি তৈরির ক্ষেত্রে এর ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। পরবর্তীতে এর ব্যবহার আরো অনেক দিকে বিস্তৃত করা হয়। তার মধ্যে রয়েছে বিমানের পাখা, গাড়ীর মোটর থেকে শুরু করে মেকানিক্যাল আরো অনেক কিছু। এই থ্রিডি প্রিন্টার মেশিনের মাধ্যমে এখন তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম বায়োনিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। থ্রিডি স্ক্রিনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে অর্গানিক কালিকে থার্মোপ্লাস্টের মাধ্যমে বায়োপ্রিন্টিং করা হয়। তারপর এর মাধ্যমে মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরি করা হয়ে থাকে। চলুন দেখে নেওয়া যাক থ্রিডি প্রিন্টিং মেশিনের মাধ্যমে এই পর্যন্ত তৈরিকৃত বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।

১. মাথার করোটি

হল্যান্ডের একটি হাসপাতালে একজন রোগীর মাথায় সফলভাবে স্থাপন করা হয়েছে থ্রিডি প্রিন্টিং এর মাধ্যমে তৈরি মাথার করোটি। সেখানের চিকিৎসকরা জানায় তাদের এই রোগীটি দীর্ঘমেয়াদী হাড়ের ব্যাথায় ভুগছিলেন। তার মাথার করোটিটি ছিল প্রায় ৫ সেন্টিমিটার মোটা। ফলে এই মস্তিস্কের স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করতো। এর ফলে রোগীর মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। ফলে তার মাথায় এই থ্রিডি প্রিন্টিং করোটি স্থাপন করা হয়।

Related Post

২. কৃত্রিম চোখ

যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ফ্রেপ ডিজাইন সম্প্রতি ১৫০টি সিনথেটিক চোখ তৈরি করেছেন থ্রিডি প্রিন্টিং এর মাধ্যমে। ইতোমধ্যে গবেষণা করা হচ্ছে যে ভবিষ্যতে চোখের প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এই চোখগুলো ব্যবহার করা যাবে কিনা। দুর্ঘটনা কিংবা জন্মসুত্রে অন্ধত্ব বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ চোখের প্রতিস্থাপন অনেক ব্যয়বহুল বলে তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠে না। এমন ক্ষেত্রে এই সিনথেটিক বায়োনিক চোখ নতুন পথের দিক নির্দেশ করবে বলে আশা করা যায়। ইতোমধ্যে ইন্ডিয়া এই সিনথেটিক বায়োনিক চোখের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। ফ্রেপ ডিজাইন কোম্পানী যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির হাসপাতালের সাথে যৌথভাবে গবেষণায় এই সিনথেটিক চোখ তৈরি করছে। তারা আশা করছে যে আগামী বছর থেকে চোখের প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এই বায়োনিক চোখ ব্যবহার করা যাবে।

৩. নাক এবং কান

ফ্রেপ ডিজাইন ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের সাথে যৌথভাবে তৈরি করছে সিনথেটিক নাক এবং কান। রোগীদের থ্রিডি মুখমণ্ডল স্ক্যানিং এর মাধ্যমে তাদের নাক এবং কানের গঠনগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। এই ধরনের স্ক্যানিং এর মাধ্যমে রোগীদের ত্বকের পিগম্যান্ট এবং ত্বকের ঘনত্ব সম্পর্কে অবহিত হতে হয়। তারপর থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে রোগীর বিশ্লেষিত ডাটা দ্বারা বায়োনিক পিগম্যান্ট, স্টার্চ পাউডার এবং সিলিকন মিশিয়ে রোগীর মুখের আকারে নাক এবং কানের রেপ্লিক তৈরি করা হয়। তারপর সার্জারির মাধ্যমে রোগীর শরীরে তা প্রতিস্থাপন করা হয়। দুর্ঘটনায় রোগীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হারানোর ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি অনেক কার্যকর উপায় হবে বলে মনে করেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এই সিনথেটিক নাক এবং কান তৈরি করছেন সম্পূর্ণ অন্যভাবে। তারা থ্রিডি প্রিন্টিং এর মাধ্যমে এক ধরনের মল্ড বা কাই তৈরি করে নিচ্ছেন। আসল কোষের সাথে কাইয়ের তৈরি কালির জেলকে একসাথে মিশিয়ে তৈরি করা হয় কৃত্রিম নাক এবং কান। প্রিন্ট করা এই সিনথেটিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয় বুবিন নামক এক প্রকার প্রানীর কোষের কার্টিলেজ এবং ইদুরের কোষের কোলাজ্যান। এই সকল উপাদানগুলো নিয়ে তিনমাস সময় ইঙ্কিউবেটরে রেখে দেওয়া হয়।

৪. কৃত্রিম ত্বক

ওয়াক ফরেস্ট স্কুল অব মেডিসিনে কাজ করেন জেমস উই। তিনি বর্তমানে গবেষণা করছেন আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীদের জন্য সিনথেটিক ত্বক কিভাবে প্রতিস্থাপন করা যায়। এনজাইম এবং কোলাজ্যান দিয়ে তৈরি কৃত্রিম কালি দিয়ে তিনি থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে তৈরি করছেন সিনথেটিক ত্বক। এই সিনথেটিক ত্বকটি সাধারণত দুই স্তর বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এর উপরের স্তর ত্বকের বহিরাবরণ বাইরের ত্বক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর নিচের স্তরটি ভেতরের আবরণ কিংবা কোষের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সিনথেটিক ত্বকের প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়াটি অবশ্যই নির্ভুল হতে হয় তাই এই ধরনের ত্বক প্রতিস্থাপনের সময় রোগীর শরীরের স্ক্যানিং করে নেওয়া হয়।

৫. দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ

থার্মোপ্লাস্টিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক নতুন পথের উন্মোচন করেছে। এরফলে এখন খুব সহজেই তৈরি করা যাচ্ছে প্রিন্ট করা হাত, বাহু এবং আলাদা আলাদাভাবে হাতের আঙ্গুল। রিচার্ড ভ্যান রোবোহ্যান্ড কোম্পানীর পরিচালক ইতোমধ্যে সিনথেটিক হাত এবং আঙ্গুল তৈরি করেছেন। এখন তারা গবেষণা করছেন এমন ধরনের হাত এবং হাতের আঙ্গুল যা সত্যিকার হাতের মতোই কাজ করতে পারবে। তারা থার্মোপ্লাস্টিকের সাথে অ্যালুমিনিয়াম পলিটেক্টাইড এবং স্টেইনলেস স্টিল একত্রিত করে থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে এই সিনথেটিক হাত এবং আঙ্গুল তৈরি করছেন। যেখানে রয়েছে ফাংশনাল মেকানিক্যাল অংশ যা সত্যিকারের হাতের মতোই কাজ করবে। তারা এরিমধ্যে সুদানে এই সিনথেটিক হাতের পরীক্ষামূলক প্রতিস্থাপন করেছেন। এই প্রোজেক্টটির নাম “প্রোজেক্ট ড্যানিয়াল”। ১৪ বছর বয়সী ড্যানিয়াল ওমর একটি হাত হারিয়েছে বোমার আঘাতে যখন সুদানে গৃহযুদ্ধ চলছিল। এখন তার শরীরে রোবোহ্যান্ডের তৈরি করা একটি সিনথেটিক হাত প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা প্রথম থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে হাড় তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারা বলছেন আমরা হয়তো খুব শীঘ্রই এই সিনথেটিক হাড়ের প্রতিস্থাপন দেখতে পাবো। থ্রিডি প্রিন্টারের কল্যাণে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন শুরু হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে তা আরো বিস্তৃত আকারে মানুষের কল্যাণে আসবে বলে আশা করা যায়।

তথ্যসূত্রঃ সিএনএন

This post was last modified on এপ্রিল ২৩, ২০১৪ 9:47 পূর্বাহ্ন

K. A. B Tohin

Recent Posts

বাংলা সাল যেভাবে এলো

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বৈশাখ এলে বাংলা সালের কথা আমাদের মনে পড়ে। আসলে এই…

% দিন আগে

নদী ও নৌকা: এক অসাধারণ গ্রামের দৃশ্য

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ শুভ সকাল। মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪ খৃস্টাব্দ, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১…

% দিন আগে

আপনি কী জনেন দিবানিদ্রার অভ্যাসে বাড়তে পারে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি!

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ দিনের বেলায় ঘুমানোকে আমরা ভাত ঘুম বলে থাকি। তবে দিনের…

% দিন আগে

ডিপিএস এসটিএস স্কুল ঢাকার ২০২৩-২৪ সেশনের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ডিপিএস এসটিএস সিনিয়র স্কুল অডিটোরিয়ামে আয়োজিত হয়েছে ডিপিএস এসটিএস স্কুল…

% দিন আগে

এসসিবি-চ্যানেল আই অ্যাগ্রো অ্যাওয়ার্ড ২০২৩: ‘সেরা কৃষি প্রতিষ্ঠান’ স্বীকৃতি পেলো আইফার্মার

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক অ্যান্ড চ্যানেল আই অ্যাগ্রো অ্যাওয়ার্ড ২০২৩- এর…

% দিন আগে

দেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রীর ছোটবেলার ছবি: বলুনতো এটি কে?

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ যে ছবিটি আপনারা দেখছেন সেটি দেশের জনপ্রিয় একজন অভিনেত্রীর ছোটবেলার…

% দিন আগে