দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ফাঁদ পেতে অপরাধ করার প্ররোচনা জুগিয়ে আবার তাকে গ্রেফতার করা বাংলাদেশী নাগরিক নাফিসকে নিয়ে সমগ্র বিশ্ব জুড়েই চলছে সমালোচনা। এফবিআই’র ‘স্টিং অপারেশন’ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
ফাঁদ পেতে অপরাধ করতে সহযোগিতা ও উৎসাহ জুগিয়ে অপকর্ম সংঘটনের ঠিক আগমুহূর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পাকড়াও করার গোটা প্রক্রিয়ার নাম ‘স্টিং অপারেশন’, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের গোয়েন্দারাই অপরাধের রহস্য উন্মোচন, অপরাধী শনাক্ত ও পাকড়াও করার কাজে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করে থাকে। বিশেষ করে, নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আল কায়দার নারকীয় হামলার পর থেকে অহরহ এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করে আসছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। ঠিক এ ধরনের অভিযানেই গত ১৭ অক্টোবর নিউইয়র্কে গ্রেফতার করা হয়েছে বাংলাদেশি ছাত্র কাজী রেজওয়ানুল আহসান নাফিসকে। অপরাধী শনাক্ত ও পাকড়াও করতে কার্যকর কৌশল হলেও স্টিং অপারেশনের নৈতিক ও আইনি দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ভবন উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে এফবিআইয়ের এই ফাঁদে বাংলাদেশি ছাত্র নাফিস ধরা পড়ার পর নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে এ অভিযান নিয়ে। নিজস্ব অর্থায়নে নিজেদের কোনো সদস্যকে ছদ্মবেশী অপরাধী সাজিয়ে কাওকে ফাঁদে ফেলা কতটা নৈতিক ও আইনসংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সমালোচকরা।
এক খবরে জানা গেছে, নাইন-ইলেভেনে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পরিকল্পনা করার অভিযোগ এনে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশকেই ধরা হয়েছে বিতর্কিত স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে। গত বুধবার বাংলাদেশি ছাত্র নাফিসকে নিউইয়র্কের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্টের আদালতে হাজির করা হলে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরে ওই আদালতের অ্যাটর্নি লরেট্টা লিনচ এক বিবৃতিতে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করে নাফিসকে গ্রেফতারে সক্ষম হওয়ায় এফবিআইয়ের প্রশংসা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বরাবরই স্টিং অপারেশনের মতো বিতর্কিত অভিযানের পক্ষে সাফাই গেয়ে আসছে। কিন্তু নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে এ অভিযান নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রশ্ন তুলছে, এ ধরনের ছদ্মবেশী অভিযান আসলেই সন্ত্রাসবাদ দমনে সহায়ক হচ্ছে কি-না। নাকি সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদের ছক আঁটতে প্রলুব্ধ করছে, যার অর্থ জোগান দিচ্ছে খোদ এফবি আই।
স্টিং অপারেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলে বার্তা সংস্থা ফ্রান্স টোয়েন্টিফোরের নাথান কিং নিউইয়র্ক থেকে পাঠানো এক রিপোর্টে বলেন, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এফবি আইয়ের সহায়তা ছাড়া এই লোকগুলো কি এ ধরনের ছক কষতে সক্ষম সে কারণে অনেকে এই অপারেশনকে বলছেন ফাঁদে ফেলা অভিযান। নাথান কিং বলেন, এ ধরনের অভিযান বরং নতুন করে সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়। ২০০৯ সালের একটি মামলায় করা একজন বিচারকের মন্তব্যের উদৃব্দতি দিয়ে নাথান এ কথা বলেন। ওই মামলায় সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে দুই ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
ওই মামলার সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এফবি আইয়ের ইনফরমার বা গোপন তথ্যদাতাদের মসজিদে যত্রতত্র অনুপ্রবেশের সমালোচনা করে। মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতারা অভিযোগ করেন, মসজিদে তাদের নামাজ আদায়কেও টার্গেট করা হচ্ছে। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার অরেঞ্জ কাউন্টিতে এর আগে মাদকের মামলায় অভিযুক্ত এফবি আইয়ের এক ইনফরমারকে মুসলমান সাজিয়ে মসজিদে প্রবেশ করানো হয়। ক্রেগ মন্টেইলহ নামে ওই ইনফরমার মসজিদে ঢুকে কয়েকশ্থ ঘণ্টার অডিও-ভিডিও করেও সেখানকার মুসলিস্নদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দাঁড় করাতে পারেননি। ওই অভিযানের পর এফবি আইয়ের বিরুদ্ধে মসজিদে নাগরিক স্বাধীনতা হরণের মামলা করা হয়। মামলাটি করেছিল আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন। কিন্তু এক ফেডারেল বিচারক ওই মামলা সরাসরি খারিজ করে দেন। ৩৬ পৃষ্ঠার আদেশে করমাক কারনি নামে ওই বিচারক বলেন, জাতীয় নিরাপত্তাকে ব্যক্তি-স্বাধীনতার ওপরে স্থান দিতে তিনি বাধ্য হয়েছেন।
এ ধরনের অনেক মামলাই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। কিছু মামলায় বিচারকরা স্বীকার করেছেন, এফবি আইয়ের কৌশল প্রশ্নাতীত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের লিগ্যাল ও সিভিল রাইটস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতদসত্ত্বেও বিচারের রায়ে ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটছে না। ফলে অভিযুক্তকে দীর্ঘদিন টানতে হচ্ছে জেলের ঘানি।
তবে এতসব সমালোচনা সত্ত্বেও নাফিস ধরা পড়ার সর্বশেষ স্টিং অপারেশনে প্রমাণ হয়, এফবি আইয়ের এ বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ কৌশল সম্ভবত চলতেই থাকবে।
জড়িত থাকলে নাফিসের শাস্তি চান প্রবাসীরা
নিউইয়র্ক থেকে এনা জানায়, বোমা ফাটিয়ে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত বাংলাদেশি নাফিস যদি সত্যিকার অর্থে দোষ করে থাকেন, তাহলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি চান প্রবাসীরা। একই সঙ্গে নাফিসের অপকর্মের দায় কোনোভাবেই গোটা বাঙালি জাতির ওপর চাপানো যাবে না বলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে প্রবাসীদের এক সমাবেশ থেকে। নিউইয়র্কে গত শুক্রবারের এ সমাবেশে বক্তারা উলেস্নখ করেন, বাংলাদেশ এবং বাঙালিরা কখনোই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদকে সাপোর্ট করে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারও সন্ত্রাসের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি পালন করে আসছেন। তাই নাফিসের অপকর্মের দায় বাংলাদেশ নিতে চায় না। তবে নাফিস যদি দোষ না করে থাকে, তাহলে তার সসম্মানে মুক্তি দাবিতে ২১ অক্টোবর রোববার নিউইয়র্কে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। তথ্য সূত্র: দৈনিক সমকাল।