এম. এইচ. সোহেল ॥ মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে নৃশংসভাবে মুসলিম নিধন ঘটনাটি সভ্য সমাজের জন্য একটি জঘন্যতম অপরাধ। বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো অবশ্য সোচ্চার ভূমিকা রেখে চলেছেন। কিন্তু ঘটনার কোন পরিসমাপ্তি ঘটছে না।
ফিলিস্তিনে মুসলমানদের ওপর ইরাইলের যে আক্রমণ চলেছে সেখানে স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রগুলো ইন্ধন যুগিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার এমন কোন বড় পরাশক্তি নয় যেখানে সবাই কাবু হয়ে থাকবে। কিন্তু তারপরও কেনো এবং কিসের ইঙ্গিতে এভাবে মুসলমানদের ওপর হামলা হচ্ছে তার কোন হদিস মিলছে না। সেদেশের সরকার মুখে বলছেন এবং আইন শৃংখলা বাহিনীকে ব্যবহার করছেন সহিংসতা রোধের জন্য কিন্তু তারপরও কোন কাজ হচ্ছে না।
গত কয়েক দশকের সমস্যা রয়েছে আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে। বছরের পর বছর একটি বিষয় নিয়ে কেনো এতো সহিংসতা চলে আসছে তা ভাববার বিষয়। কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে এই দাঙ্গা আবার শুরু হয়। গত মে মাসে একজন বৌদ্ধ নারীকে কয়েকজন মুসলমান ধর্ষণ করেছে বলে গুজব রটে। এ খবরের পরিপ্রেক্ষিতে তখন বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। তখন নিহত হয়েছিল ৯০ জন। এর পরপরই রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। তবে এবারের সহিংসতার কারণ কী তা জানা যায়নি। রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধরা একে অপরকে দায়ী করছে। নতুন করে শুরু হওয়া সহিংসতায় ১১২ জন নিহত হয়েছে বলে সরকারিভাবে স্বীকার করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো উগ্র বৌদ্ধদের গণহত্যার শিকার মুসলমানদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে জানিয়েছে। জুন মাসে দাঙ্গা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত জাতিসংঘের হিসাবে গৃহহীনের সংখ্যা অন্তত লাখ খানেক।
রোহিঙ্গাদের মুসলমানদের নিয়ে চলছে শত বছর ধরে বিতর্ক। বিতর্ক যাই হোক না কেনো। তাদের জন্মস্থান কেনো তাদের হবে না। আমাদের দেশেও হিন্দু মুসলমান, খৃস্টান, বৌদ্ধ বসবাস করছে। তারা জন্ম সূত্রে এদেশের নাগরিক। তাদের সব রকমের অধিকার আমাদের দেশে রয়েছে। তারা ভোট দিচ্ছেন। এমপি হচ্ছেন, এমনকি মন্ত্রীও হচ্ছেন। আমাদের দেশ একটি মুসলিম দেশ হলেও অন্য ধর্মবলম্বীদের কোন বিধি নিষেধ নেই। রামুতে যে ঘটনাটি ঘটেছে এটি ছাড়া আমাদের দেশে বড় কোন ঘটনার কোন নজির নেই। কিন্তু মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যুগ যুগ ধরে যে অত্যাচার নির্যাতন চলছে তার কোন মিমাংসা হচ্ছে না কেনো? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিগত সমস্যা রয়েছে। সমস্যা থাকাটায় স্বাভাবিক কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে সমস্যা সে সমস্যা আরও আগেই মিটে যাওয়া উচিত ছিল। কারণ রোহিঙ্গা মুসলমানরা প্রকৃতপক্ষেই মিয়ানমারের নাগরিক। বংশ পরাংপরায় তারা সেদেশে বসবাস করছেন। তারপরও তাদের ওপর কেনো এই অমানবিক নির্যাতন? হাজার হাজার ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আদি যুগের মতো মানুষের ওপর চালানো হচ্ছে নির্যাতন। যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
‘আমাদের ঘরে থাকতে বলে বাইরে থেকে আগুন দিল তারা’
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের উপকূলীয় শহর কাইয়াউকপাইউতে বৌদ্ধ রাখাইন ও মুসলমান রোহিঙ্গাদের মধ্যে ছয় দিনের দাঙ্গার পর ২৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে নিজেদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন বেঁচে যাওয়া মুসলিম রোহিঙ্গারা। জ্বলন্ত বাড়ি-ঘর থেকে বের হয়ে বুলেটের মুখে পড়ে, সেখান থেকে মাছ ধরার নৌকায় আশ্রয় নিয়ে খোলা সাগরে ভেসে জীবন রক্ষা করতে হয়েছে তাদের। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এই দাঙ্গার পর ২২ হাজার ৫৮৭ জন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, নিহত হয়েছে ৮৪ জন। চার সন্তানের জননী আশ্রা বানু বলেন, “আমাদের ঘরে থাকতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ঘরে থাকার পর বাইরে থেকে তারা আগুন লাগিয়ে দেয়।” ২৪ অক্টোবর কাইয়াউকপাইউতে আশ্রা বানুদের এলাকা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে পালিয়ে আসেন তিনি। “দৌড়ে বাড়ির বাইরে এসে আমরা গুলির মুখে পড়ি, পুলিশ আর রাখাইনরা মিলে গুলি করছিল। আগুন নেভানোর চেষ্টাও করতে পারিনি, প্রাণপণ দৌড়ানোর চেষ্টা করে গেছি।” নিউ ইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দাঙ্গার আগে ও পরের কাইয়াউকপাইউর স্যাটেলাইট ছবি প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায় এখানকার মুসলিম এলাকা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ঐ এলাকার ৮১১টিরও বেশি ভবন ও ভাসমান বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। রবিবার নতুন কোনো সংঘর্ষ হয়েছে বলে শোনা যায়নি। তারপরও সিতউয়ির কাছে তে চায়ুঙ্গ আশ্রয়কেন্দ্রে নতুন শরণার্থীদের লম্বা মিছিল দেখা গেছে। এদের অধিকাংশই কাইয়াউকপাইউ থেকে আসছে। ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া ৬৩ বছরের বৃদ্ধা জামিলা বলেন, “ছুরি নিয়ে রাখাইনরা আমাদের মারতে আসে। তারা আমাদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়, আমরা কিছুই আনতে পারিনি। যা পরে আছি এটাই এখন একমাত্র পোশাক। আমি আর ফিরতে পারব না।” মিয়ানমার সরকারের হিসাব মতে, ২১ অক্টোবরের পর থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। রবিবার দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জানানো হয়েছে, দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা ৬৭ জন থেকে বেড়ে ৮৪ জনে দাঁড়িয়েছে। তবে দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে ধারণা মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর। অন্যদিকে রাখাইন বৌদ্ধরা দাবি করেছে, মুসলিমরাও তলোয়ার, ছুরি ইত্যাদি নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, ঘর-বাড়িতে আগুন দিয়েছে।
এসব ঘটনার মধ্যদিয়ে বার বার একটি প্রশ্ন আজ দানা বেধে ওঠে আর তা হলো, আজ মানুষের মানবিক মূলবোধ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? কারণ সব ধর্মেই বলা হয়েছে, পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখ-সমৃদ্ধ জাগ্রত করার কথা। মানুষ মানুষকে ঘৃণা না করা, মানুষের কল্যাণে নিজকে নিবেদিত করা এমন সব ভালো কথায় বলা হয়েছে সব ধর্মেই। কিন্তু তারপরও কেনো মানুষ হয়ে আরেক মানুষের ওপর হামলা করা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় বসতবাড়ি, বিতাড়িত করা হয় নিজ অধিকার থেকে- এসব অমানবিকতা কি কোন দিন শেষ হবে না? ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীর মোহ থেকে কবে মানুষ সরে আসবে? এখন এই প্রশ্নই আমাদের তাড়া করছে প্রতিনিয়ত।