দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়াটিয়া হলেও সরকার তাদের স্বার্থরক্ষায় বরাবরই উদাসীন। আইন থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। যে কারণে যার যেমন খুশি ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছেন। রাজধানীবাসীর একেবারে নাভিশ্বাস অবস্থা।
রিয়াজ উদ্দীন : ১১৬/এফ উত্তর মুগদা পাড়ার ভবনটিতে খুব ছোট ছোট ফ্ল্যাট। একটি বেডরুম আর কিছু ফাঁকা জায়গা। প্রতি ফ্ল্যাটের ভাড়া প্রায় ৯ হাজার টাকা। আগে ভাড়া ছিল সাড়ে ৭ হাজার টাকা। জানুয়ারি থেকে দিতে হবে ৯ হাজার টাকা। না দিতে পারলে ভাড়াটিয়াদের বলা হয়েছে চলে যেতে।
ক্ষুব্ধ ভাড়াটিয়া ঢাকা কলেজের ছাত্র রফিক বললেন, ব্যাচেলর থাকি। বাসা পরিবর্তনও করতে পারবো না। কাজেই থেকে যেতে হবে এখানেই। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, যেহেতু ছোট্ট বাসা কাজেই সেখানেই গাদাগাদি করে পাঁচজন থাকেন। এতো কষ্ট করে থাকার পরও ভাড়া নাগালের বাইরেই চলে গেলো। বিষয়টি নিয়ে বাড়ির মালিক আবুল খায়েরের সঙ্গে কথা বলতে ফোন করা হয়। কিন্তু আবুল খায়ের কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
একই অবস্থা আজিমপুর এতিমখানার পেছনের ‘জব্বার বাড়ি’র। একেকটি টিনশেড রুমের ভাড়া চার মাস আগেও ছিল চার হাজার টাকা। সেই ভাড়া এখন পাঁচ হাজার টাকা করা হয়েছে। সরেজমিন ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এই ভাড়ায় অন্য কোথাও থাকা সম্ভব নয়। টিনশেড বাড়ি পাওয়া যায় না। কাজেই বাধ্য হয়ে এখানেই থাকতে হয়। ভাড়াটিয়ারা নানা অভিযোগ করলেও কেওই নাম প্রকাশ করতে চান না। তাদের আশঙ্কা নাম প্রকাশ করলে তাদের তুলে দেয়া হতে পারে।
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে একজন ভাড়াটিয়া বললেন, নাম বলতে সমস্যা ছিল না যদি বাড়িওয়ালার শাস্তি হতো। কিন্তু সমস্যা হলো বাড়িওয়ালার তো শাস্তি হবেই না বরং আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হতে পারে। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, সবকিছুর দাম বেড়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিলও বেড়েছে। কাজেই ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় নেই।
একই অবস্থা পুরো ঢাকা শহরেরই। দেড় কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরে মানুষের তুলনায় থাকার জায়গা অপ্রতুল। এর সুযোগ নিয়ে বাড়িওয়ালারা দেড় কোটি মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছে। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি) সূত্র জানায়, ঢাকা শহরে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ বাড়ির মালিক। বাকি ৯০ শতাংশ মানুষই ভাড়া থাকে। কিন্তু এই কোটি কোটি মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই বিষয়টি নিয়ে কোনো সরকারই কখনো মাথা ঘামায়নি।
রাজধানীর ২২ বছরের (১৯৯০-২০১১) বাড়ি ভাড়া নিয়ে একটি জরিপ করেছিল কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সেই জরিপ রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ঢাকা শহরে ২২ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৫০ শতাংশ। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। লাগামহীন এই বাড়ি ভাড়া মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।
ক্যাবের সভাপতি কাজী ফারুক বলেন, এই শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়াটিয়া হলেও সরকার বরাবরই উদাসীন। একটি আইন আছে সেটিরও বাস্তবায়ন নেই। সিটি করপোরেশনের তালিকা আছে সেটিও মানা হয়নি।
ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির অন্তর্ভুক্ত ১০টি এলাকার বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া আছে। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) আমলেই এটা করা ছিল। সেই তালিকা ওয়েবসাইটে দেয়া আছে। কিন্তু সেই তালিকা মানা হয় না। ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, তালিকা দেয়া থাকলেও তালিকা মেনে চলতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এমন কোনো আইন নেই।
শহরে ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া পাওয়া খুব কঠিন। অনেক ব্যাচেলর মজা করে বলেন, যে বাসায় মানুষ থাকতে পারে না সে বাসায় ব্যাচেলর থাকে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোনো মালিকের যদি একাধিক বাড়ি থাকে তার মধ্যে যে বাড়িটা সবচেয়ে খারাপ সেই বাড়িটাই ব্যাচেলরদের জন্য ভাড়া দেয়া হয়। কারণ সেই বাড়িতে ফ্যামিলি নিয়ে থাকা যায় না। আবার কোনো মালিক যদি ভালো বাড়িতে ব্যাচেলর ভাড়া দিতেও চায়, সেক্ষেত্রে ভাড়া চায় অনেক বেশি। এর সঙ্গে আবার ‘এক পৃষ্ঠার নিষেধাজ্ঞা’, এক ঘণ্টার নোটিশে বাসা ছাড়ার মতো শর্তও দেন মালিকপক্ষ। কোনো উপায় না থাকায় সেসব শর্ত মেনেই ব্যাচেলরা বাসা ভাড়া নেন।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সমগ্র ঢাকা শহরকে ১০টি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করে আলাদা-আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় ডিসিসি। কিন্তু এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ডিসিসি নির্ধারিত ভাড়া নেয়া হচ্ছে না। ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডিসিসি আবাসিক এলাকাকে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। মেইন রোডের পাশে হলে এক রকম ভাড়া, গলির তিনশ ফুটের মধ্যে হলে এক রকম ভাড়া আর গলির তিনশ ফুটের বাইরে হলে আরেক রকম ভাড়া। আবার আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প- এ তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এছাড়া হোল্ডিং নম্বর, নির্মাণের সময়কাল, কাঠামো, নির্মাণশৈলী, অবস্থান ও পজেশন হস্তান্তরের শর্তের ওপর ভিত্তি করে ভাড়ার তারতম্য হতে পারে বলে ডিসিসি বিধান করেছে। কিন্তু এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মালিকরা এসব নিয়ম মানছেন না, ভাড়া নিচ্ছেন ফ্রি স্টাইলে।
ঝিগাতলার জন্য মেইন রোডের পাশে প্রতি বর্গফুট স্পেসের জন্য ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে ৮ টাকা। কিন্তু নেয়া হচ্ছে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ারা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়া ডিসিসির এ নিয়ম জানেনই না। অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত ধানমণ্ডিতে দেখা গেছে, এক হাজার ২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের ভাড়া প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু ডিসিসির বেঁধে দেয়া ভাড়ার হিসেবে ওই ফ্ল্যাটের ভাড়া হওয়ার কথা ১৪ হাজার ৪০০ টাকা। একই চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর অন্য এলাকাগুলোতেও।
শুক্রাবাদ, রায়ের বাজার ও তেজকুনীপাড়া ঘুরে দেখা গেছে, ছোট্ট আধাপাকা ঘরের ভাড়া নেয়া হচ্ছে তিন হাজার টাকা। এরকম একেকটি ঘরে ১০/১২ জন মানুষ গাদাগাদি করে থাকে। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ভোরের কাগজ)।