দি ঢাকা টাইম্স ডেস্ক ॥ আবার পোশাক কারখানায় আগুন, আবার বন্ধ দরজার কারণে শ্রমিকদের মৃত্যু। আর কত দিন দেখতে হতে আমাদের এমন বিভৎস্য কাহিনী? আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসের পর ২৬ জানুয়ারি এবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধে একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন ৭ পোশাক শ্রমিক।
জানা যায়, আগুনের এই ঘটনায় আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। আগুন ধরার পর ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে, হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে সিঁড়িতে পদদলিত হয়ে এবং আগুন থেকে বাঁচতে লাফিয়ে পড়ে তারা মারা যান। ঘটনার দিন দুপুরের খাবারের বিরতি শেষে গার্মেন্টকর্মীরা পৌনে ২টার দিকে কাজে ফিরে দেখতে পান, দোতলার বাথরম্নমের পাশে গুদামঘরের দিকে আগুন জ্বলছে। সঙ্গে সঙ্গে তারা আতঙ্কিত হয়ে নিচের দিকে নামতে শুরম্ন করেন। কারখানার দুটি গেটের মধ্যে একটি তালাবদ্ধ ছিল। খোলা ছিল শুধু লোহার সরু সিঁড়িটি। সিঁড়িটি দিয়ে একসঙ্গে দু-তিনজনের বেশি নামা যায় না, সেখানে আতঙ্কে হুড়োহুড়ি শুরু হলে কয়েকজন পুলিত হয়ে গুরুতর আহত হন। প্রচণ্ড ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন কয়েকজন এবং ভয়ে লাফ দিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হন আরো অনেকে। ঘটনাস্থল থেকে ১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয় এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৬ জনকে মৃত ঘোষণা করে। দুপুরের বিরতির সময় না হলে হয়তো হতাহতের সংখ্যা আরো বেশি হতো।
জানা গেছে, গার্মেন্টস কারখানাটি আবাসিক এলাকার একটি দোতলা ভবনে অবস্থিত, যার নিচতলায় রয়েছে একটি বেকারি ও তিনটি ওয়ার্কশপ। বলাই বাহুল্য কারখানাটি যথাযথ আইনকানুন মেনে স্থাপিত হয়নি এবং যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ পারিচালিত হচ্ছিল না। গত বছরের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে সরকারি হিসেবেই ১১২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। সে ঘটনায়ও মূল গেট তালাবদ্ধ রাখা এবং যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ব্যাপক প্রাণহানির কারণ হিসেবে আলোচিত। তখন দেশের সব পোশাক কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার অনেক প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনার কথাই সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে শোনা গিয়েছিল, কিন্তু দু মাসের মাথায় আবারো অগ্নিকাণ্ড, গেটে তালা, প্রাণহানির ঘটনা- সবকিছুকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাজরীনের ঘটনার পর সংসদীয় কমিটি স্পষ্ট বলেছিল যে, ‘তাজরীনের মালিকই অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী’, মালিককে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবিও করেছিল কমিটি। কিন্তু আজ পর্যন্ত মালিককে গ্রেফতার করা বা এ ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। শতাধিক মানুষের প্রাণসংহারের বহুল আলোচিত ঘটনায়ও যদি দায়ীরা পার পেয়ে যেতে পারে তাহলে পুনরাবৃত্তি তো ঘটা আর অস্বাভাবিক কি? এই দায়হীনতার ধারা শুধু মূল্যবান জীবননাশই ঘটাচ্ছে না, গোটা শিল্প খাতটিকেই হুমকিতে ফেলছে বলে সকলের ধারণা।
উল্লেখ্য, গত ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা, গ্রহণযোগ্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, শ্রমিকদের জন্য কল্যাণমূলক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। অন্যথায়, অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা বাতিলের হুশিয়ারি দিয়েছে তারা। সর্বশেষ অগ্নিকাণ্ডটি যখন ঘটেছে তখনো বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত পরিদর্শনে আসা যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধিদল দেশে অবস্থান করছে। শনিবারের ঘটনা তাই দেশের গার্মেন্টস রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার আশঙ্কা প্রবল। গেলো দুই দশকে সাভার ও আশুলিয়ায় পাঁচশর বেশি গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও এখনো অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে অধিকাংশ কারখানা। এখনো যথাযথ নিয়ম মেনে ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করছে না অনেক কারখানা। বলাই বাহুল্য এসবই আমাদের গার্মেন্টস খাতের কাঙ্খিত বিকাশে বড় প্রতিবন্ধকতা। এসব দূর করতে আর সামান্য বিলম্বও হবে আত্মঘাতী। সম্ভাবনার গার্মেন্টস কারখানায় আর স্বজনের লাশ, স্বপ্নের লাশ দেখতে চাই না আমরা। আমরা চাই যে খাতটি এদেশের অর্থনীতিতে এতোবড় ভূমিকা রাখছে সে খাত রক্ষার্থে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নইলে এর জন্য আমাদেরকে বড় মাশুল দিতে হবে।