দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ সারাদেশে আবারো ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাস। মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসি আর) সূত্রে বলেছে, এবারের শীত মওসুমে নিপাহ ভাইরাসে ১২ জন আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জনই মারা গেছে। ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের কার্যক্রম খুবই দুর্বল।
প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির এ দায়িত্ব সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের। বিভাগটি এ দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নিপাহ ভাইরাসের ব্যাপারে প্রচারণার মাধ্যমে সারাদেশে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে অনেককেই মৃত্যু থেকে রক্ষা করা সম্ভব বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
সর্বশেষ গত বুধবার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিপাহ ভাইরাসে এক শিশু মারা গেছে। শিশুটি ফটিকছড়িতে তাদের বাড়িতে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এর আগে ২১ জানুয়ারি ঢাকায় ৮ বছরের এক শিশু মারা যায়। ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে খেজুরের কাঁচা রস এনে ওই শিশু ও তার বাবা খেয়েছিল। পরে ব্যবসায়ী বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, বাদুড় হলো নিপাহ ভাইরাসের একমাত্র বাহক। শীত মওসুমে বাদুড় সন্ধ্যার পর খেজুরের কাঁচা রস খায়। বাদুরের মাধ্যমে খেজুরের রসে ভাইরাস ছড়ায়। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে গেলেও এ রোগ ছড়াতে পারে। তাই খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছে আইইডিসিআর। তবে বিষয়টি গ্রামাঞ্চলের মানুষ জানে না।
চলতি শীত মওসুমে রাজশাহী, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, নওগাঁও নাটোর, গাইবান্ধা জেলায় ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আইইডিসিআর সূত্র জানায়, নিপাহ ভাইরাস সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আগে ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলা ও বৃহত্তর রংপুরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা গিয়েছিল। বর্তমানে রাজশাহী বিভাগ, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে।
আইইডিসিআর্থর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এম মোশতাক হোসেন বলেন, অন্যান্য বিভাগগুলোতে তাদের সার্ভিসেস টীম অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছেন।
আইইডিসিআর কর্মকর্তারা বলেন, ২০০১ সালে এদেশে সর্বপ্রথম নিপাহ ভাইরাস প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। তবে হঠাৎ আক্রান্ত লোকজন মারা যাওয়ায় প্রথমে এটাকে জাপানিজ এনক্যাফালাইটিজ রোগ মনে করা হয়েছিল। ২০০৪ সালে বের হয়ে আসে এটা এনক্যাফালাইটিজ রোগ নয়; নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমণ।
১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম নিপাহ গ্রামে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে লোক মারা যায়। বাদুড়ের খাওয়া তাল শূকরের খাবারে পড়ে। শূকরের মাধ্যমে নিপাহ গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। পরে ওই গ্রামের নামে ভাইরাসটির নাম রাখা হয় নিপাহ। এ ঘটনার তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশে ২০০১ সালে নিপাহ ভাইরাসের প্রার্দুভাব শুরু হয়। সরকারি তথ্যানুযায়ী এ পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে ১৮০ জন সংক্রমিত হন। এর মধ্যে মারা যায় ১৩৯ জন। মৃত্যুর হার ৮০ ভাগ। বেসরকারি তথ্যমতে একযুগে মৃত্যু হার তিনগুণ।
২০০১ সালে মেহেরপুরে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ১৩ জনের মধ্যে ৯ জন মারা যায়, ২০০৩ সালে নওগাঁও আক্রান্ত ১২ জনের মধ্যে ৮ জন মারা যায়। ২০০৪ সালে রাজবাড়ীতে ১০ জন, ফরিদপুরে ২৭ জন, জয়পুরহাটে ৪ জন, মানিকগঞ্জে ৪ জন ও নওগাঁও ২ জন মারা যায়। ২০০৫ সালে টাঙ্গাইলে ১০ জন ও কুষ্টিয়া ৫ জন মারা যায়। ২০০৮ সালে মানিকগঞ্জে ৪ জন ও রাজবাড়িতে ৫ জন এবং ২০১০ সালে ফরিদপুরে ৭ জন মারা যায়। ২০১১ সালে রাজবাড়িতে ২ জন, রংপুরে ৫ জন, দিনাজপুরে ৪ জন, লালমনিরহাটে ২০ জন এবং ২০১২ সালে জয়পুরহাটে ৬ জন ও রাজবাড়ীতে ২ জন মারা যায়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, খেজুরের কাঁচা রস ও বাদুড়ে খাওয়া ফল খাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারলে নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তবে খেজুরের রসের গুড় ও পায়েস খাওয়া যাবে। আগুনের তাপে এ ভাইরাস মারা যায়। আবার ফল সাবান দিয়ে ধুয়ে খেলে এ ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হবে না। নিপাহ ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে না তুললে সারাদেশে মৃত্যু আরো বেড়ে যাবে। এ রোগের লক্ষণ হচ্ছে, প্রচণ্ড জ্বর, মাথাব্যথা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিচুনি ও শ্বাস কষ্ট। ভাইরাস সম্পর্কে ঘরে ঘরে সতর্কবার্তা পৌছে দেয়া সরকারের তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয় বলে জানান চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খন্দকার সিফায়েত উলস্নাহ বলেন, আক্রান্ত এলাকায় সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে প্রচার ও নানা কার্যক্রম চলছে। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মাইকিং ও পোস্টার লাগানো হচ্ছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় এভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলে তিনি জানান।