দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ মানবিক মূল্যবোধ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা এই কাহিনী না পড়লে বোঝা যাবে না। একটি শিশুর দুটি হাত কেটে দিয়েছে তার পাষণ্ড পিতা! এমন জঘন্য ঘটনাও আমাদের পড়তে হচ্ছে।
আমাদের সমাজে এখনও এমন অনেক ঘটনায় ঘটছে যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এমনই একটি ঘটনা গত কয়েকদিন ধরে টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখা যাচ্ছে। বড়ই জঘন্যতম ঘটনা। বটির ঘায়ে শান্ত নামে একটি শিশুর দুই হাত কেটে ফেলেছে পাষণ্ড পিতা। ধারণা করা হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামাতেই এই পৈশাচিক কাণ্ড। শান্ত নামে এই ছেলেটি কিছুই জানে না, শুধু জানে চিপস খেতে চাওয়ার জন্য তার নিজেরই সৎ বাবা বটি দিয়ে তার দুই হাত কেটে তাকে চিরদিনের জন্য প্রতিবন্ধী করে দিয়েছেন। এই পৈশাচিক ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায়। প্রায় দেড় মাস আগে ঘটলেও সম্প্রতি ঘটনাটি নজরে আসে সংবাদকর্মীদের। পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, গত দেড় মাস ধরে নিখোঁজ ছিল শান্ত। শিশুটির দুই হাত কেটে পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামিয়ে টাকা আয় করতেই তার সৎ পিতা জাহাঙ্গীর এ ঘটনা ঘটিয়েছে। গত ২২ মার্চ শান্ত’র মা নাসিমা বেগম দুই হাতবিহীন পুত্রকে ফিরে পেয়েছেন। তিনিও এ বর্বরতার জন্য তার দ্বিতীয় স্বামী জাহাঙ্গীরকে দায়ী করেছেন। তবে ভিক্ষাবৃত্তির ঘটনার সঙ্গে নাসিমাও জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় বনানী থানায় মামলা হলেও জাহাঙ্গীরকে পুলিশ এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি।
শিশু শান্ত ও তার এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আট বছরের শিশু রবিউল ইসলাম শান্ত তার মা গৃহকর্মী নাসিমা বেগম ও সৎ পিতা হোটেল কর্মচারী জাহাঙ্গিরের সঙ্গে মহাখালী কড়াইল বস্তিতে থাকে। গতকাল শনিবার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শান্ত এই প্রতিনিধির সামনে ঘটনার বর্ণনা দেয়। জানা গেছে, ঘটনার দিন গত ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে শান্ত বস্তিতে খেলছিল। মা নাসিমা বেগম রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল। এ সময় শান্ত তার পিতা জাহাঙ্গীরকে দেখে চিপস কিনে দেয়ার জন্য বলে। সৎ পিতা জাহাঙ্গীর চিপস কিনে না দিয়ে উল্টো তাকে ধমক দেয়। ওই সময় শান্ত তার পিতাকে বলে উঠে, ‘তুমি কোন দিন কিছু কিনে দেও না একটি চিপস চাইলাম তাও দেও না। তুমি কিসের বাবা।’ এ কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে জাহাঙ্গীর ‘তোরে জনমের মত চিপস খাওয়াচ্ছি’ বলতে বলতে শান্তর হাত ধরে তাকে তেজগাঁও এলাকায় একটি মসজিদের কাছে জংগলে নিয়ে যায়। তারপর শান্তর দুই পা চেপে ধরে বটি দিয়ে তার ডান হাতটি কনুই পর্যন্ত কেটে ফেলে। এ সময় শান্ত চিৎকার দেয়া শুরু করলে তার মুখ চেপে ধরে জাহাঙ্গির। কিছু সময় পর পিতাকে বলে, ‘তুমি আমার ডান হাতটি কেটে ফেললা, আমি কিভাবে খাবো এ কথায় পাষণ্ড জাহাঙ্গীর তার বাম হাতটিও কেটে ফেলে। এরপর শান্ত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরে মাথা ও দেহের বিভিন্ন স্থানে বটি দিয়ে আঘাত করে তাকে ফেলে চলে যায় জাহাঙ্গীর। ইত্তেফাক প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলার সময় শান্ত বেশ কয়েকবার হাতের কাটা অংশের দিকে অসহায়ের মত তাকায়। এ দৃশ্য দেখে দর্শণার্থী কয়েকজনের চোখ ভিজে ওঠে।
এদিকে শিশুটির মা নাসিমা বেগম বেলা ২টা পর্যন্ত শান্ত বাসায় ফিরে না আসায় খোঁজাখুজি শুরু করেন। এক পর্যায়ে মাইকিং ও পরদিন বনানী থানায় জিডি করেন। ঘটনার পর থেকে তার দ্বিতীয় স্বামী জাহাঙ্গীর বাসায় আসে নি। তবে ঘটনার রাতে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নাসিমার দেখা হয়। তখন শান্ত নিখোঁজ থাকার কথা বলা হলে, জাহাঙ্গীর আসছি বলে আর আসে নি। তার ভূমিকা প্রথম থেকেই সন্দেহজনক ছিল বলে নাসিমা জানান। তিনি আরো জানান, ‘জাহাঙ্গীর একজন নেশাখোর। তাকে দিয়ে পুত্রের দুই হাত কাটা কেন, খুন করাও সম্ভব বলে নাসিমা জানান। তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে বনানী থানায় পুত্র শান্তর দুই হাত কেটে নেয়ার ঘটনায় মামলা করেছেন।
পুলিশ ও চিকিৎসক সূত্র জানায়, স্থানীয় থানার পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় শান্তকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। তখন তার বাম হাতটি দেহের সঙ্গে ঝুলছিল। ডাক্তাররা হাতটি রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইনফেকশন দেখা দিলে হাতটি দেহ থেকে অপসারণ করতে বাধ্য হন । দুই সপ্তাহ পর শান্ত মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠে। অল্প অল্প কথা বলা শুরু করলে শিশুটিকে নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘সচিত্র প্রতিবেদন’ প্রকাশিত হয়। পত্রিকা দেখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা রোকশানা বেগম শিশুটিকে দেখার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান। বিস্তারিত জেনে তিনি শান্তকে পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করেন। গত ১৬ মার্চ তাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠেছে শান্ত।
এ ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে গুলশান জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার লুৎফুল কবীর সাংবাদিকদের বলেছেন, গত শুক্রবার শান্তকে নিয়ে বনানী থানার পুলিশ কড়াইল বস্তিতে আসে। শান্তর দেহে দুই হাত না দেখে বস্তিবাসীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি নিজেই মামলাটির তদারকি করছেন। ভিক্ষাবৃত্তিতে নামানোর কৌশল হিসাবেই জাহাঙ্গীর ও তার সহযোগীরা শিশুটির হাত কেটেছে বলে প্রাথমিক ভাবে ধারণা করছে পুলিশ। ঘটনার পর থেকে জাহাঙ্গীর পলাতক রয়েছেন। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, শান্তর মা নাসিমার প্রথম স্বামী কামাল ছিলেন গুলশান এলাকার সিকিউরিটি গার্ড। তার ঘরে শান্তসহ দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে রিয়াজ (১০) গুলশান ২ নম্বরে একটি ক্রোকারিজের দোকানে কাজ করে। জাহাঙ্গীরের ঘরে নাসিমার আরো একটি কন্যা সন্তান হয়। তার নাম রিচান, বয়স ৯ মাস।
শিশুটির সাক্ষাৎকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে আসার পর জনমনে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়। শিশুটিকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, তুমি লেখা পড়া করবা কিভাবে। সে প্রতি উত্তরে বলেছে, ‘আমি মুখ দিয়া লেখুম, তাও আমি পড়া লেখা করুম।’
এদিকে এই ঘটনার জন্য দোষীদের শাস্তি দাবি করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।