দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আরম্ভ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অবকাঠামো ও পরিচালনার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরের মোট ভূমির সিংহভাগ ব্যয় হয়েছে শিক্ষা ভবন বা একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণের জন্য নয়, বরং ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষক-কর্মচারীর আবাসন খাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ৬০ শতাংশ ভূমি এখন আবাসিক এলাকা, ২৫ শতাংশ অঞ্চল রাস্তা ও প্রশাসনিক ভবনের আওতায়। আর মাত্র ১৫ শতাংশ ভূমি শিক্ষা ভবন বা একাডেমিক বিল্ডিংয়ের অধীনে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের হল ও শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য যতটা চাপে থাকে, একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণের জন্য ঠিক ততটাই চাপমুক্ত। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা প্রথম বর্ষে হলে আসন বরাদ্দ পান না। একই অবস্থা ছাত্রী হলগুলোতেও।
দেশের প্রায় সব সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ অবস্থা বিদ্যমান। পাশ্চাত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের অনেকেই থাকেন কোন না-কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা ও অধ্যাপনাসূত্রে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নোবেল পুরস্কার অর্জনের মতো গবেষণার সূতিকাগার হতে পারছে না। এর প্রধান কারণ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব বিদ্যা চর্চা কেন্দ্রের বদলে পরিণত হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আবাসস্থলে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বজ্ঞানের চর্চা ও প্রসারের জন্য চাই অনুশীলন ও চর্চার কেন্দ্রের সম্প্রসারণ। তার বদলে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রধান দাবি, স্ব-স্ব আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য, একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণ নয়। ছাত্রসংগঠনগুলোও হল নির্মাণের দাবিতে যতটা সোচ্চার, একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণের দাবিতে ততটা সোচ্চার নয়। ফলে আগামী ৫০ বছর পর আমাদের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি পরিপূর্ণভাবে আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান ভবন দীর্ঘ ছয় বছরেও সম্পূর্ণতা পায়নি, আদৌ পাবে – এমন কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। কলাভবনের মূল পরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছু বিভাগ যথেচ্ছভাবে সম্প্রসারণ করে চলেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য, ভবন সম্প্রসারণের অর্থ যেহেতু তারা বাইরের দাতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে, সেহেতু নিজেদের প্রয়োজনমতো তারা সম্প্রসারণকাজ করছে। অপরদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪০ বছর পর সেখানে রাস্তার ওপর একটি ‘কলা ভবন’ (অনেকে নাকি ঠাট্টা করে ‘কলার ভবন’ বলে) নির্মিত হয়েছে—যেটি অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং যেখানে স্থাপত্য-মনোযোগ ও নান্দনিকতার কোনো ছাপ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ, জ্বীন-প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ কিংবা সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, বায়োটেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার, ব্যবসায় গবেষণা ব্যুরো, অর্গানিক পল্যুট্যান্টস গবেষণাকেন্দ্র ইত্যাদির মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও কেন্দ্র সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হলেও এসব ক্ষেত্রে আধুনিক পঠন-পাঠনের শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা প্রয়োজন, কর্তৃপক্ষ সেদিকে নজর দিতে পারছে না। বরং বলা চলে, ‘ছাত্ররাজনীতি’র তুরুপের তাস হিসেবে সিট-বাণিজ্য ছাত্রনেতাদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে এবং হত্যা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মারামারিতে কলুষিত করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-পরিবেশ। শিক্ষকদের জন্যও আবাসনব্যবস্থা একটি লোভনীয় টোপ। শিক্ষক-রাজনীতি অনেকটাই এই টোপ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। অথচ, শিক্ষক পদে চাকরি বা ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির বিজ্ঞাপন কোথাও এ কথা উল্লেখ থাকে না যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আবাসনের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় নেবে।
কাজেই সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এবং একাডেমিক ভবন নির্মাণে সকল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নইলে এভাবে ভূমি নাশ করে নির্বিচারে আবাসিক ভবন নির্মিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতি দ্রুতই তার প্রকৃত চেহারা হারিয়ে ফেলবে। চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এই প্রক্রিয়া আরম্ভ হতে পারে। কিংবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেহাত হওয়া ভবনগুলো উদ্ধার করে সেখানে একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণ করেও এই প্রক্রিয়া আরম্ভ হতে পারে।