দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ মাত্র ৪টি বিস্কুট ও ১ বোতল পানি খেয়ে ১৭ দিন পার করেছেন। দুঃসহ সেই দিনগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন সাভারের ঘটনায় জীবিত উদ্ধার পাওয়া রেশমা। গতকাল তাকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি করা হয়।
রেশমা তার বর্ণনায় বলেন, ধ্বংসস্তূপের ভেতরে চারদিকে অন্ধকার। আলো-বাতাস কিছুই নেই। পুরো সময়টাতে শুধু আল্লাহকে ডেকেছি। ভাবিনি কখনো এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাবো। আসলে আল্লাহর ইচ্ছাতেই বেঁচে গেছি।’ কেঁপে কেঁপে নিস্তেজ কণ্ঠে গতকাল সোমবার বিকালে দুঃসহ সেই ১৭ দিনের বর্ণনা দিলেন রেশমা বেগম। বার বার থেমে থেমে যখন বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা বলছিলেন তখন তার চোখেমুখে ছিল কষ্ট আর আতঙ্কের ছাপ।
গতকাল বিকালে সাভার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন রেশমা বেগমকে উপস্থিত করা হয় সাংবাদিকদের সামনে। রেশমার পরণে ছিল সাদা-খয়েরি রংয়ের চেক ম্যাকসি। মাথা ঢাকা ছিল চাদরে। রেশমা সাংবাদিকদের সামনে আসবেন এ খবরে গতকাল রাজধানী থেকে সবকয়টি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মী এবং স্থানীয় সাংবাদিকরা হাজির হন সাভার ক্যান্টনমেন্টে। এসেছিলেন কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধিও। দুপুরে সাংবাদিকদের সামনে আসার কথা ছিল রেশমার। তিন দফা সময় পরিবর্তনের পর বিকাল ৫টা ১৮ মিনিটে হুইল চেয়ারে করে সিএমএইচ-এর বারান্দায় আসেন রেশমা। ৫টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। দেশের বেশ কিছু চ্যানেল সরাসরি সমপ্রচার করে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ঢাকা সিএমএইচের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশফাক-উজ-জামান, সাভার সিএমএইচে রেশমার চিকিৎসায় গঠিত সাত সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কর্নেল আজিজুর রহমান এবং সাভার সিএমএইচের অধিনায়ক লে. কর্নেল শরীফ আহম্মেদসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তা।
রেশমা সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার দিন অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল সকালে অন্যান্য দিনের মতো রানা প্লাজায় যাই। ভবনে ফাটল ধরা পড়ায় আগের দিন রানা প্লাজার ভেতরের সব গার্মেন্টস ছুটি হয়ে যায়। ওই দিন সকাল ৮টার মধ্যে রানা প্লাজার ৯৫ ভাগ শ্রমিক ভবনের সামনে উপস্থিত হন। রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা এবং গার্মেন্টসের কর্মকর্তা স্যারেরা বলেন, দেয়াল সামান্য ফেটে গেছে। সিমেন্ট বালু দিয়ে তা ঠিক করে দেয়া হচ্ছে। কোন সমস্যা নেই। অনেকে ভয়ে উঠতে চায়নি। চাকরি রক্ষায় অন্যান্য শ্রমিকদের সঙ্গে আমিও রানা প্লাজার তিন তলায় যাই।
ঘটনার আকস্মিকতার বর্ণনা দিতে গিয়ে রেশমা বলেন, এর কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বিকট শব্দে ভবন কেঁপে উঠে। শ্রমিকরা জীবন রক্ষার জন্য এদিকওদিক ছোটাছুটি শুরু করে। সিঁড়ি দিয়ে হুড়াহুড়ি করে বের হতে থাকে তারা। এ সময় বিকট শব্দে ভবন ধসে পড়ে। আমার সঙ্গে আমার আরেকজন সহকর্মী ছিল। সে হাত ধরে বলে, আপু আমরা দুইজন এক সঙ্গে বের হবো। মুহূর্তে ছাদ ধসে পড়লো। সে হাত থেকে ছুটে যায়।
রেশমা জানান, তার মাথা দেয়ালে আঘাত লাগে। মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। একটু পরে জ্ঞান ফিরে দেখেন যে, তার শরীর থেকে মাত্র এক ফুট উপরে দেয়াল। চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছিল পানি পানি ও বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার। রেশমার সামনে কিছুসংখ্যক ইট দেখতে পান। হাতের কাছে পান একটি লাঠি। এ অবস্থায় লাঠি দিয়ে আস্তে আস্তে ইট সরিয়ে একটি ছিদ্র করেন। এ ছিদ্র দিয়ে রেশমা তিন তলার সিঁড়ি থেকে দোতলায় চলে আসেন। এ সময় তার বেশ কয়েকজন সহকর্মী রেশমাকে আপু আপু আমাদেরকে বাঁচান বলে চিৎকার করেন। এ সময় রেশমার চিৎকার শোনা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। দোতলায় যাওয়ার পর চারটি বিস্কুট ও এক বোতল পানি পেয়েছেন তিনি। এগুলো খেয়ে তিনি ১৭ দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।
তার পরনের কাপড় ছিড়ে গেছে। মাথার চুল আটকে ছিঁড়ে গেছে। সে বেঁচে থাকবে সেটা তার চিন্তার বাইরে ছিল। মলমূত্র ত্যাগ করেছেন পরনের কাপড়ে। এ কথা বলতে বলতে হঠাৎ স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন। একটু পর আবার বলা শুরু করেন ধ্বংসস্তূপে কত দিন ছিলাম তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। চারদিকে শুধু অন্ধকার। উপরে ভারি যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ চলছে তা বুঝতে পারছিলাম। ১৭ দিনে একটু একটু শব্দ শুনেছেন। বুঝতে পেরেছি উপরে কিছু একটা হচ্ছে। এর বেশ কিছুক্ষণ পর একটু আলো দেখতে পান। লাঠি দিয়ে উপরে নাড়া দেন। সেই সংকেত পেয়ে উদ্ধার কর্মীরা বলেন, কেও আছেন, থাকলে শব্দ করুন। উত্তরে রেশমা বলেন ভাই আমাকে বাঁচান। তার আহ্বান শুনতে পান উদ্ধারকর্মীরা। তাকে একটি টর্চলাইট দেন। সেই টর্চলাইটের আলোতে রেশমা নতুন কাপড় খুঁজে পান। সেখান থেকে নতুন কাপড় পরে রেশমা বের হয়ে আসেন।
রেশমা এখন আগের চেয়ে অনেক সুস্থ বলে সাংবাদিকদের জানান। তবে সুস্থ হয়ে কি করবেন উত্তরে রেশমা জানান, আর গার্মেন্টসে ফিরে যাবো না। এ সময় মনোরোগ বিজ্ঞানী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশফাক বলেন, রেশমা এখনো ট্রমার মধ্যে। পুরাপুরি স্বাভাবিক হলে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে বলে তিনি জানান। ২০১০ সালের জুন মাসে দিনাজপুর থেকে ঢাকায় আসেন রেশমা। গত ২ এপ্রিল অর্থাৎ ভবন ধসের মাত্র ২২ দিন আগে তিনি রানা প্লাজার তৃতীয় তলার গার্মেন্টসে চাকরি নেন। মাসিক বেতন সব মিলিয়ে ৪৭০০ টাকা।
উল্লেখ্য, সাভার ট্র্যাজেডির ১৭ দিনের মাথায় ১০ মে বিকালে তাকে জীবিত উদ্ধার করে সাভার সিএমএইচ-এ ভর্তি করা হয়। তাকে উদ্ধারের পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ব্যাপক আকারে তাকে উদ্ধারের খবর প্রকাশ করা হয়।