দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ এক শহরে পড়ে রয়েছে টনকে টন হীরা! আপনি এমন খবর পড়ে হয়তো ছুটে যাওয়ার কথা চিন্তা করবেন। কিন্তু এই প্রশ্নও আপনার মনে আসতে পারে। আর তা হলো এটি কী আসলেও সম্ভব?
আমরা সবাই জানি বাঁ হাতের অনামিকায় হীরার আংটির অর্থই হলো বিয়ের বাদ্যি বেজে ওঠা। হীরাখচিত গয়নার প্রতি আকর্ষণ অবশ্য সকলের রয়েছে। হীরা নিয়ে মানুষের আগ্রহের যেনো শেষ নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, পৃথিবী থেকে ৪০ আলোকবর্ষ দূরে বলে সে হিরে জোগাড়ের চেষ্টা আপাতত করা সম্ভব নয় কারও পক্ষেই। তবে আপনি জানেন কি, এই পৃথিবীতেই এমন একটি শহর রয়েছে, যার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে লাখ লাখ হীরা!
এমন একটি খবর শুনে আপনি হয়তো বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে ফেলতেই পারেন! ভালো! তবে সেই হীরার রাজ্য দেখতে হলে এবার ঘুরে আসুন জার্মানির নর্দলিনগেন শহর।
বিবিসির প্রতিবেদক ম্যাথু ভিকেরি সম্প্রতি নর্দলিনগেন ঘুরে এসে জানিয়েছেন অত্যাশ্চর্য সেইসব হীরা কাহিনী। ব্যাভারিয়া অঞ্চলের প্রাচীন এই শহরে গথিক-স্থাপত্যরীতি মেনে বানানো সেন্ট জর্জেস গির্জা সিঁড়ি ভেঙে টাওয়ারে ওঠার সময় তিনি খেয়াল করেন, সূর্যের আলোয় পাথুরে সিঁড়িগুলো কেমন যেনো ঝিক করে উঠছে। যেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল তার কাছে।
গির্জাটি বানানোর সময়কাল হলো ১৪২৭-১৫০৫ খ্রিষ্টাব্দ। এতো পুরোনো গির্জার সিঁড়ি কালচে-বাদামি রং ধারণ করার কথা ছিলো, তা না হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে! এর কারণ ব্যাখ্যা করলেন গির্জার টাওয়ারের রক্ষী হোর্স্ট লেনার, ‘গোটা টাওয়ারটি বানানো হয়েছে সুভাইট পাথর দিয়ে। এর ভেতরে রয়েছে বহু হীরা। ভাগ্যিস হীরাগুলো অনেক ছোট। তা না হলে এই গির্জা কবেই ভেঙে ফেলা হতো হীরার জন্য!’
লেনার কৌতুক করে বললেও কথাটি কিন্তু একেবারে মিথ্যা নয়। লিখিত ইতিহাস অনুযায়ী নর্দলিনগেনের গোড়াপত্তন নবম শতকে হয়েছিলো। শহরটি তৈরির সময় সেখানকার স্থানীয় লোকজন জানতো না, যে পাথর দিয়ে শহর গড়ছে তারা, তার মধ্যে রয়েছে ছোট ছোট বহু হীরা। এখন প্রশ্ন হলো এই পাথর এলো কোথা থেকে?
জানা যায়, প্রায় দেড় কোটি বছর পূর্বে নর্দলিনগেন অঞ্চলে আছড়ে পড়েছিল ১ কিলোমিটার প্রশস্তের একটি গ্রহাণু। সেকেন্ডে ২৫ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানা সেই গ্রহাণু সেখানে ২৬ কিলোমিটার অঞ্চল নিয়ে একটি গর্তের সৃষ্টি করেছিলো। আঘাতের চাপে এবং তাপে কার্বন রূপান্তরিত হয় ভীষণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হীরাকে, যা মরিচের গুঁড়োর মতো মিশে গেছে সুভাইট পাথরের ভেতর। হীরাগুলো এতোই ছোট যে আকারে ০.২ মিলিমিটারের কম। খালি চোখে দেখা খুবই কঠিন।
জানা যায় যে, গ্রহাণুর সেইসব সুভাইট পাথর দিয়েই বানানো হয়েছে শহরটির বেশির ভাগ বসতবাড়ি। অর্থাৎ, হীরার বাড়ি, হীরার শহর—এমন জায়গা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই! নর্দলিনগেনের বাসিন্দা রোজউইথা ফেইলের ভাষ্য মতে, ‘এই শহরের মধ্যে যা কিছু দেখছেন, সবই সেই গ্রহাণুর আঘাতের কারণে সৃষ্ট পাথর দিয়ে গড়া।’ অথচ পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত এখানকার বাসিন্দারা মনে করতেন যে, শহরটি কোনো মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের উপর বানানো হয়েছে। ষাটের দশকে নর্দলিনগেনে ঢুঁ মেরে তাদের ভুল ভাঙিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ভূতত্ত্ববিদ ইউজেনে শুমেকার ও এডওয়ার্ড চাও। এই দুই ভূতত্ত্ববিদ প্রমাণ করেছিলেন যে, নর্দলিনগেন আসলে বসে রয়েছে পৃথিবীতে আছড়ে পড়া একটি গ্রহাণুর ওপর!
নর্দলিনগেনের স্থানীয় ভূতাত্ত্বিকদের ধারণা মতে, এই শহরে প্রায় ৭২ হাজার টন হীরার মজুত রয়েছে! তবে সবই সুভাইট পাথরের মধ্যে মিশ্রিত হয়ে আছে। সুভাইট পাথর পৃথিবীর আরও বেশ কিছু স্থানে মিলেছে, একই ঘটনার (গ্রহাণুর আছড়ে পড়ার) ফলাফল হিসেবে। তবে সেসব জায়গায় পাথরের মধ্যে ‘জেমস্টোন’(রত্নপাথর)-এর মিশ্রণ নর্দলিনগেনের মতো এতো বেশি পরিমাণ নয়। এখানকার পাথরের নমুনা দেখতে নর্দলিনগেনে নিয়মিতই আসেন নাসা বা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির মহাকাশচারীরা।
আপনি আশ্চর্য হবেন, শহরের পরতে পরতে হীরা মিশে থাকলেও স্থানীয় লোকদের তা নিয়ে কোনো রকম আগ্রহ নেই। প্রায় প্রতিদিনই পর্যটক, ভূতত্ত্ববিদ বা মহাকাশচারীদের আনাগোনা দেখে অধিবাসীরা আশ্চর্য হয়ে যান। তাদের প্রশ্ন, এখানে এতো দেখারই বা কী আছে?
নর্দলিনগেনের রাইয়েসক্রাটর জাদুঘরের পরিচালক ডক্টর স্টেফান হোলজের নিকট মিললো সেসব প্রশ্নের জবাব, ‘এখানকার সবকিছুর সঙ্গে কোটি কোটি বছর পূর্বের ঘটনাপঞ্জির যোগসূত্র রয়েছে। ব্যাপারটা হয়তো অতীত, তবে আপনি এখনও তা দেখতে পাচ্ছেন। এখানকার বর্তমান তো আসলে অতীতেরই একটি ফসল।’