দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বুকে ইনফেকশন নিউমোনিয়া হলে অনেক সময় আমরা খুব মামুলি রোগ হিসেবেই এটিকে মনে করি। কিন্তু এই ইনফেকশন নিউমোনিয়ার সময় মতো চিকিৎসা না করলে জীবন বিপন্ন হতে পারে। কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে আলোচনা করা হবে বুকে ইনফেকশন নিউমোনিয়া হলে কি করতে হবে।
ঘটনা ১ : বেশ ক’দিন ধরেই ঐশী দারুণ সর্দি-কাশিতে ভুগছে। সঙ্গে জ্বরও আছে। সারারাত ঘুম নেই। কফ সিরাপেও কিছু হচ্ছে না। তার বাবা-মা ভাবছেন, এটা কি নিউমোনিয়া?
ঘটনা ২ : স্কুলে তিতিরের বন্ধুর নিউমোনিয়া হয়েছে, তিতিরও কয়েক সপ্তাহ আগে জ্বর থেকে উঠল, তিতিরেরও নিউমোনিয়া হতে পারে কি?
এটা কি ছোঁয়াচে?
নিউমোনিয়া নিয়ে এমন হাজারো প্রশ্ন আমাদের মনে। এইড্স ম্যালেরিয়া ও মিজেলস মিলিয়ে শিশু মৃত্যুর যা হার, নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুর হার তার থেকে অনেক বেশি।
নিউমোনিয়া আসলে কী
নিউমোনিয়া ফুসফুসের ইনফেকশন। ভাইরাল ইনফেকশন এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে নিউমোনিয়া হওয়ার আশংকা বেশি, কারণ বাচ্চাদের ডিফেন্স মেকানিজম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বড়দের তুলনায় দুর্বল। দ্বিতীয়ত খোলামেলা পরিবেশ, নানা রকম লোকজন সব মিলিয়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান
বাচ্চাদের ফুসফুসের রোগ থাকলে যেমন অ্যাজমা, সিস্টিক ফাইব্রোসিস (যেখানে পাকস্থলী, প্যানক্রিয়াস প্রভৃতি জায়গায় দেহের মিউকোসাল সিক্রেশন চটচটে হয়) হলে ফুসফুসে ইনফেকশন হয়।
দেহের গঠনগত সমস্যা অর্থাৎ বাচ্চার শ্বাসনালী ও খাদ্যনালী জোড়া থাকলে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ ক্ষেত্রে খাবার খেলে সেটা শ্বাসনালিতে ঢুকে যায়। একে বলে ট্র্যাকিও ইজোফেজিয়াল ফিস্টুলা।
গ্যাস্ট্রো ইজোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ যেখানে বাচ্চা যা খায় তাই বমি করে ফেলে বা খাবার পেট থেকে ফুসফুসে ফেরত চলে যায়।
নিউরোলজিকাল ডিজিজ- পেশী দুর্বল থাকার জন্য এ বাচ্চারা ভালো করে কেশে কফ বের করতে পারে না। খাবার শ্বাসনালিতে ঢুকলে কেশে বের করতে পারে না। স্প্যাস্টিক চাইল্ড হলেও সমস্যা দেখা যায়।
ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি অনেক ক্ষেত্রে জন্মের সময় থেকে রক্তে ইমিউনিটি তৈরির উপাদান কম থাকে। এ ছাড়া এইড্স, থ্যালাসেমিয়া হলেও প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
সাধারণ সর্দি কাশি ও নিউমোনিয়া
বাচ্চাদের সাধারণত সর্দি, হাঁচি-কাশি, জ্বর লেগেই থাকে। বিশেষ কয়েকটি লক্ষণ থেকে বুঝতে হবে বাচ্চার নিউমোনিয়া হয়েছে। প্রথমত সর্দি-কাশি, জ্বরের সঙ্গে বাচ্চা যদি খুব তাড়াতাড়ি নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে, ২ বছরের কম বয়সের বাচ্চা যদি প্রতি মিনিটে ৫০ বারেরও বেশি নিঃশ্বাস নেয় এবং ২ বছর বয়সের ওপরের বাচ্চা যদি প্রতি মিনিটে ৪০ বারেরও বেশি নিঃশ্বাস নেয়, তাহলে বুঝতে হবে এটা সাধারণ সর্দিজ্বর নয়। দ্বিতীয়ত শান্ত অবস্থায় বাচ্চার যদি নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, নিঃশ্বাস নিতে গেলে ঘড়ঘড় আওয়াজ হয়, তা হলে সেটা নিউমোনিয়ার লক্ষণ।
নিউমোনিয়া কি ছোঁয়াচে
বাচ্চাদের যেহেতু প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, তাই ছোঁয়াচে বলা যেতে পারে। বাচ্চাদের নাক-কানে নিউমোনিয়া হওয়ার ব্যাক্টেরিয়া অবস্থান করে। প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে তখন নিউমেনিয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
কখন ডাক্তার দেখাবেন
নিঃশ্বাস নেয়ার সময় বাচ্চার পেট ঢুকে গেলে।
নিঃশ্বাস নেয়ার সময় নাক ফুলে উঠলে।
মুখ ও ঠোঁটের চারপাশ নীল হলে। সঙ্গে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর।
বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। এ অবস্থায় সাধারণত বাচ্চা বুকের যে দিকে ব্যথা করে সেই দিকটা ধরে থাকে। যে দিকে ব্যথা সেই দিকে পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। হাঁটু মুড়ে, হাঁটুটাকে বুকের কাছে এনে পাশ ফিরে থাকে।
ঘনঘন শুকনো কাশি। কাশি হলেও কফ বের করতে না পারা।
সব সময় মনে একটা অস্বস্তি, অ্যাংজাইটি থাকা।
চিকিৎসা
প্রথমেই দরকার রুটিন টেস্ট আর বুকের এক্স-রে করা। এক্স-রেতে জানা যায় নিউমোনিয়া হয়েছে কিনা আর রুটিন ব্লাড টেস্টে ধরা পড়বে বাচ্চার ভাইরাল না ব্যাকটেরিয়াল কোন ধরনের নিউমোনিয়া হয়েছে। তারপর ডাক্তারের পরামর্শমতো তাড়াতাড়ি অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করা উচিত। প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বাচ্চাকে স্টিম ভেপার দিতে পারেন। শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে প্রথম থেকেই ভালোভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন। খাওয়া-দাওয়া, পরিচ্ছন্নতা, পরিবেশ সব দিকেই বিশেষ খেয়াল রাখা দরকার।
খাওয়া-দাওয়া
মায়ের দুধ একান্ত জরুরি। এর কোনও বিকল্প নেই। অপুষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে শাকসবজি, তাজা ফল, টাটকা মাছ খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে। ভিটামিন সিরাপও খাওয়ানো যেতে পারে। সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হচ্ছে, খাবারে যেন যথেষ্ট পরিমাণে জিংক থাকে। এর জন্য বাচ্চা খেতে পারে মুরগির মাংস, চিজ, মসুর ডাল, বিন, কর্নফ্রেক্স, চিড়া ইত্যাদি।
পরিবেশ
বহু লোকের ভিড় বা ওভারক্রাউডেড জায়গায় বাচ্চাদের বেশি না নিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। সেই সঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বাচ্চাদের রাখুন। বিশেষ করে বাচ্চাদের সামনে ধূমপান করলে তাদের ফুসফুসে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ভ্যাকসিন
নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করার জন্য ভ্যাকসিনের চল এখন বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে ভ্যাকসিন ব্যবহারে বাচ্চাদের নিউমোনিয়া কমেছে। মিজেলস ভ্যাকসিন, হেমোফেলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন, নিউমোক্কাল ভ্যাকসিন ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন নিলে ভালো। এর মধ্যে হেমোফেলাস ও নিউমোক্কাল ভ্যাকসিন বাচ্চাদের দেয়া হয় ২ মাস বয়সে। মিজেলস ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন বাচ্চার ৯ মাস বয়সে। এভাবে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা হলেও নিউমোনিয়া যে একেবারে হবে না, তা নয়। বার বার নিউমোনিয়া হলে বাচ্চার মেনিনজাইটিস, অস্টিও ম্যালাইটিস, আর্থ্রাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
# লেখক ঃ ডা. গৌতম দাশ গুপ্ত মেডিকেল অফিসার, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন