মাসুমা বিল্লাহ্ ॥ আমাদের সামাজিক কাঠামোতে পরিবার মৌলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হয়, পরিবার যদি হয় সমাজের নিউক্লিয়াস আর সেই নিউক্লিয়াসই যদি হয় নিরাপত্তাহীন তবে গোটা সমাজ কতটা নিরাপদ তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। নারী যদি হয় মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক আর এই অর্ধেক জনগোষ্ঠী যদি তার নিজ বাসগৃহে হয় নিরাপত্তাহীন তবে তো মেনে নিতেই হয় সমাজ অর্ধেক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
পাশ্চাত্যের অনুকরণে সমপ্রতি আমরা উদ্যাপন করলাম মা দিবস। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নানা রকম উপহার সামগ্রীর পসরা নিয়ে বসেছিল এ দিনে । নগরের বিদ্যালয়গুলো কোমলমতি শিশুদের পাঠদানের ফাঁকে ফাঁকে জানিয়েছে মা দিবসের মহিমা, মায়ের মহিমা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ছিল দারুণ সব স্ট্যাটাসে ঠাসা । মাকে ভালোবাসে না বা মায়ের জন্য বুকের মাঝে খচ্খচানি নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল । মাকে হারিয়ে যে অনুভূতি তা মনে হয় পৃথিবীর সব মানুষের বুকে সর্বকালেই একই সুরে অণুরিত হয়ে আসছে। যে মাকে নিয়ে এত ভালোবাসা, সে মা আসলে কে? হয় আমার মা বা আপনার মা বা অন্য কারো মা, একটু ভেঙে বললে সে মা হয় ছিল আপনার মা অথবা আপনার সন্তানের মা। এই দুই পরিচয়ে মহিমান্বিত মা গৃহে তবে কেন এত অবহেলিত, অত্যাচারিত?
মা দিবস অথবা নারী দিবস পালনের ইত্যবসরে আমরা আসুন একটু ভাবি মা বা নারীর জন্য নিরাপদ গৃহ কি আমরা আজও নিশ্চিত করতে পেরেছি ? যে মা আমাদের ভালোবাসার মণিকোঠায় সর্বোচ্চ আসনে, সে মা’র ওপর যখন তখন নেমে আসে নির্মম পারিবারিক নির্যাতন। আমাদের সমাজ কাঠামোতে পারিবারিক নির্যাতন এখন আর কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, একটি সামাজিক ব্যাধি, প্রতিদিনের সংবাদপত্রের বৃহদাংশ জুড়ে ব্যাপৃত উল্লেখযোগ্য সামাজিক দিননামচা। এখানে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেল্থ সার্ভে সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে (প্রকাশিত ২০০৯) প্রথমবারের মতো তাদের দেশব্যাপী জরিপ প্রশ্নপত্রে পারিবারিক নির্যাতনকে অন্তর্ভুক্ত করেছে যা কিনা প্রকারান্তরে বাংলাদেশে পারিবারিক নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান বিস্তারকেই নির্দেশ করে। উল্লিখিত প্রতিবেদনে বিপদ এবং ঝুঁকির ওপর ভিত্তি করে ৮ রকমের নির্যাতন সম্পর্কিত তথ্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ভয়াবহতা অনুযায়ী এগুলো হলো (১) ধাক্কা, ক্রোধবসত : ঝাঁকি অথবা কোন কিছু নিক্ষেপ করা, (২) চড় দেয়া, (৩) চামড়া মুচড়ে দেয়া এবং চুল ধরে টানা, (৪) হাত দিয়ে বা আঘাত লাগতে পারে এমন কিছু দিয়ে ঘুসি দেয়া, (৫) লাথি দেয়া, প্রহার করা এবং টেনে আছড়িয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিক্ষেপ করা, (৬) ত্বকে কোন কিছু ডাবিয়ে দেয়া অথবা পুড়িয়ে দেয়ার জন্য জ্বলন্ত কিছু চেপে ধরা, (৭) ছুরি, বন্দুক বা অন্য কোন অস্ত্র নিয়ে হুমকি দেয়া বা আঘাত করা, (৮) শারীরিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে যৌন সম্পর্কে বাধ্য করা। প্রথম ৭টি নির্যাতনকে শারীরিক নির্যাতন এবং সর্বশেষটিকে যৌন নির্যাতন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেল্থ সার্ভে থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বিবাহিত নারীর প্রায় অর্ধেক (৪৯%) স্বামী কর্র্তৃক কোন না কোন প্রকার শারীরিক নির্যাতনের শিকার, ১৮% নারী স্বামী দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার এবং অর্ধেকের বেশি (৫৩%) নারী স্বামী কর্র্তৃক কোন না কোন প্রকার শারীরিক অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। সর্বাধিক মামুলি নির্যাতন হিসেবে উঠে এসেছে চড় দেয়া এবং ৪৬% নারী যখন তখন স্বামী কর্তৃক চড় থাপ্পড়ের শিকার হয়ে থাকে এবং ১৫% নারী লাথি ও প্রহারের শিকার হয় । অপেক্ষাকৃত কম বয়সী বিবাহিত নারীরা (১৫ থেকে ২৪ বছর) অধিক হারে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে এবং এ সংখ্যা প্রতি ৫ জনে ১ জন। প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায় যে, পারিবারিক নির্যাতনের সঙ্গে পারিবারিক আচার বা রীতির একটা সম্পর্ক রয়েছে। যেসব পুরুষ তাদের পারিবারিক পরিমণ্ডলে পিতা বা অন্য পুরুষ সদস্য কর্র্তৃক নারী সঙ্গীকে নির্যাতনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিল, পরবর্তীকালে তারা নিজেরাও অধিক হারে পারিবারিক নির্যাতনে অংশ নিয়েছে।
যে নারী মা, যে নারী মমতাময়ী, যে নারী তার সন্তান সে ছেলে বা মেয়ে যেই হোক না কেন তাকে আগলে রাখে নিরন্তর, যে নারী প্রাণান্ত পরিশ্রম করে, কষ্ট করে একটি সুখী গৃহ নির্মাণে, সেই গৃহই নারীর জন্য কতটা বিপজ্জনক তা এই রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান। বলে রাখা সমীচীন যে, এটাই কিন্তু পারিবারিক নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র নয়। বাংলাদেশে পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, পারিবারিক নির্যাতনের মাত্র ১% জনসমক্ষে বা আলোচনায় আসে, বাকি ৯৯% থেকে যায় পর্দার অন্তরালে। বলার অপেক্ষা রাখে না, শুধু মানসম্মান আর সামাজিক লাজলজ্জার (পঁষঃঁৎধষ ংরষবহপব) কারণে পারিবারিক নির্যাতনের প্রকৃত চিত্রের কোন এক ভগ্নাংশের ধারণাই তুলে ধরা সম্ভব হয়, আর এই ভগ্নাংশের চিত্রই যদি এতটা ভয়াবহ হয় তবে সামগ্রিক অবস্থা যে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের চিত্র ফুটিয়ে তুলে তা নিঃসন্দেহে নিদারূণ হতাশাব্যঞ্জক।
পারিবারিক নির্যাতনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে এটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং নির্যাতনকারী নির্যাতিতের নিকটজন অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে নির্যাতনকারী হল সেই ব্যক্তি যে কিনা নারীর সর্বাধিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সামাজিক, আইনগত ও মানসিকভাবে দায়বদ্ধ হওয়ার কথা। প্রায় সব ক্ষেত্রেই নির্যাতিত নারী সামাজিক চাপে নির্যাতনকারীর সঙ্গে বসবাসে বাধ্য থাকে। গৃহ যা কিনা নিরাপত্তার প্রথম আশ্রয়স্থল, তাকে নিরাপদ করতে সমাজ বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তখনই এগিয়ে আসে যখন নির্যাতন গ্রাস করে ব্যক্তির সর্বস্ব অথবা যখন অত্যাচারিত নিজে নিরুপায় হয়ে অভিযোগ প্রকাশ করে (যা আমাদের সমাজে কদাচিৎ ঘটে থাকে)।
আমাদের সামাজিক কাঠামোতে পরিবার মৌলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হয়, পরিবার যদি হয় সমাজের নিউক্লিয়াস আর সেই নিউক্লিয়াসই যদি হয় নিরাপত্তাহীন তবে গোটা সমাজ কতটা নিরাপদ তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। নারী যদি হয় মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক আর এই অর্ধেক জনগোষ্ঠী যদি তার নিজ বাসগৃহে হয় নিরাপত্তাহীন তবে তো মেনে নিতেই হয় সমাজ অর্ধেক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ তো গেল প্রত্যক্ষ নিরাপত্তাহীনতা, এবার আসি পরোক্ষভাবে কারা পারিবারিক নির্যাতনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে তাদের প্রসঙ্গে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পারিবারিক নির্যাতনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবারের শিশুরা, এতে শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তাদের স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হয় এবং পরবর্তীকালে এই শিশুরাই অধিক হারে পারিবারিক নির্যাতনে জড়িয়ে পড়ার আশংকার মধ্যে থাকে। সুতরাং গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সমাজের অর্ধেক নারী যদি কোন না কোন প্রকার পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়, তবে কি আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের অর্ধেক সদস্যের বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তৈরি করে দিচ্ছি না? যে শিশু আপনার, যে আপনার উত্তরাধিকার, যার পরিপূর্ণ বিকাশ আপনার জীবনের অর্থকেই পাল্টে দিতে পারে, যে শিশু কিনা পারে সম্ভাবনার অপার দুয়ারকে উন্মুক্ত করে দিতে পারে আপনারই জন্য, যে শিশু পরিবার সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় মূলধন, তার বিকাশকে আমরা রুদ্ধ করব আমাদেরই আচরণগত ভুলে বা সাময়িক রাগ ক্রোধকে সংবরণ করতে না পারার খেসারতে! আসুন একটু গভীরভাবে ভেবে দেখি।
মানছি যে, অনেক না পাওয়ার ভিড়ে চলতি শতাব্দীর নারী এগিয়েছে কিন্তু কম নয়। নারী আজ নভোচারী, রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধান নির্বাহী কিংবা গবেষক। নারী এখন স্কুল পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ নারী নিজেই নির্ধারণ করছে সে নিজেকে কোথায় সম্পৃক্ত করবে, সংসার পরিচালনায়, নাকি উপার্জনে- নাকি দুটোতেই । কিন্তু নারীকে গৃহেই যদি নিরাপত্তা দেয়া না যায় তবে নারীর সব বিকাশ নীরবে স্তব্ধ হয়ে যাবে । নারীকে ঘিরে যে পরিবার, সে পারিবারিক কাঠামোকে বাঁচাতে আসুন নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা পরিহারে নারী পুরুষ সবাই যে যার অবস্থান থেকে কাজ করে যাই।
নারী মানুষ, যেমনি পুরুষও মানুষ। নারী অধিকার মানবাধিকার। আসুন আমরা মানবিক হই, নারী পুরুষ মিলে একটা মানবিক সমাজ গড়ি। নারীর আচরণে নমনীয়তা, ভালোবাসতে পারার নারীর অসীম ক্ষমতা, সহজে ক্ষমা করতে পারার নারীর উদারতা, ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতিকে সামলে নিতে নারীর সক্ষমতা, অন্যকে অতি যত্নে আপন করে নেয়ার নারীর পারঙ্গমতা, সন্তানকে নিবিড় ভালোবাসায় একটু একটু করে জীবন রসে সিক্ত করার নারীর অভিলাষ- এর কোনটিই কিন্তু নারীর দুর্বলতা নয় বরং নারী হিসেবে এগুলো তার উদ্বৃত্ত অর্জন, নারী ব্যক্তিত্বের বিকশিত দিক। পরিবার যদি সমাজের নিউক্লিয়াস হয় তবে পরিবারের নিউক্লিয়াস কিন্তু নারী। সব ভণ্ডামি, কপটতা পরিহার করে আসুন আমরা যে যার অবস্থান থেকে পারিবারিক নির্যাতনকে (ফড়সবংঃরপ ারড়ষবহপব) প্রতিহত করি । আর একটা বিষয় মনে না রাখলে কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আপনি নিজেই, আর তা হল- পারিবারিক নির্যাতনের সবচেয়ে বড় কুফলভোগী কিন্তু আপনারই সন্তান, আপনারই আত্মজ। পারিবারিক নির্যাতন আপনার শিশুর মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করবে অনিবার্যভাবে। (আমাদের দেশের নারীরা চিরদিনই অবহেলিত। গ্রাম-গঞ্জে অবহেলার শিকার এমন নারীর সংখ্যা এখনও অনেক রয়েছে। এই সব নারীদের কথা বিবেচনা করেই দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত মাসুমা বিল্লাহর এই লেখাটি পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো)
মাসুমা বিল্লাহ্ : গবেষক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত
b-masuma@hotmail.com