এম. এইচ. সোহেল ॥ সারাদেশ জুড়ে সম্প্রতি মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। অবশ্যই এটি একটি ভালো খবর। তবে এই মাদক বিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। যে কারণে মানবাধিকারের প্রশ্ন উঠে আসছে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাহ্যিক দৃষ্টিতে মাদক বিরোধী অভিযান চালানোর সময় যে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহত হচ্ছে সেটি দেখে কেও প্রতিবাদ করেনি। কারণ সন্ত্রাসীরা ধরা পড়লে তারা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যায় বা জামিন পেয়ে যায়। আর জামিন পেয়েই আবারও শুরু করে মাদক ব্যবসা। তাই এরা ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহত হলেও কেও কিছু মনে করে না। যারা এই ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহত হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক (কারও কারও বিরুদ্ধে ৮ থেকে ১০টি করে মামলা) এই ধরনের মামলা রয়েছে। মাদক বিরোধী অভিযানে দেশজুড়ে মোট নিহতের সংখ্যা (২৩ তারিখ পর্যন্ত) ৫৩ জন, যার মধ্যে গত চার দিনেই নিহত হয়েছে ৪১ জন। যদিও বহির্বিশ্বের দিকে তাকালে চিত্র দেখা যাবে ভয়াবহ। যেমন ফেব্রুয়ারির এক তথ্যে দেখা যায়, ফিলিপিন্স সরকারের মাদক বিরোধী অভিযানে নিহতের সংখ্যা ২০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। দেশটির পার্লামেন্টের এক বিরোধী দলীয় সিনেটর একে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই তথ্য বলে জানিয়েছেন। তবে আমরা এমনটি কখনও প্রত্যাশা করি না। আমাদের প্রত্যাশা দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। যাতে তারা বিচারের ফাঁক ফোকরের মধ্যে বেরিয়ে যেতে না পারে সেই দিকটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।
মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই ৮ থেকে ১০ জন করে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু শুধু কি এই লোকগুলোই মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত? এই প্রশ্ন আসতেই পারে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে অনেক বড় বড় গড ফাদার যুক্ত আছেন। তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাচ্ছেন। তাহলে মূলোৎপাটন না করতে পারলে সমস্যা থেকেই যাবে। মাদকের গডফাদারদেরকে আইনের আওতায় আনতে পারলে তবেই এই মাদক বিরোধী অভিযান সার্থক হতো। সরকারের উদ্যোগ ভালো ছিলো কিন্তু শুধুমাত্র তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষুদ্র
মাদক ব্যবসায়ীদের উপর অভিযান চালিয়ে পুরো ফল পাওয়া যাবে না। তাই রাঘব বোয়ালদের ধরার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। অর্থাৎ প্রয়োজনে মৌমাছির আক্রমণকে উপেক্ষা করে হলেও ‘মৌচাকে ঢিল’ দিতে হবে।
এতো ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহতের পর একটি প্রশ্ন এসে যায়, আর তা হলো মানবাধিকারের প্রশ্ন। আইনের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া দরকার। আইনের ফাঁক ফোকরে যাতে ওরা পার না পায় সেই বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে। অর্থাৎ বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের দেশে কোনো বিচার সঠিকভাবে করা সম্ভব হয় না। গাড়ি চালক বেপরোয়া গাড়ি চালায়, মানুষকে হত্যা করে কিন্তু তারপরও তার সঠিক বিচার করা যায় না। বিচার করলেই গাড়ি বন্ধ করে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। শুরু হয়ে যায় এক অরাজকতা! কোনো হাসপাতালের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তখন দেখা যায় সারাদেশের হাসপাতালে চিকিৎসক ধর্মঘট শুরু হয়ে গেছে। যে কারণে আইনের শাসক প্রতিষ্ঠা করা আমাদের দেশের জন্য একটি দুরুহ কাজ। সরকার ইচ্ছা করলেও অনেক কিছুই করতে পারে না। তাছাড়া রাজনীতি ও দলীয় বিষয়গুলোতো আছেই। এভাবেই চলছে আমাদের দেশ। ভালো কাজ করলে তার প্রসংশা করা হয় না। খারাপ কাজ করলে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়ে যায়। এমন অনেক অসম কালচার পরিবর্তন করা দরকার। সরকারি দলে থাকলে সব ভালো, আর বিরোধী দলে থাকলে সবই খারাপ এই কালচারটিও আমাদের পরিবর্তন করতে হবে।
আমরা অনেক সময় দেখেছি, যিনি আওয়ামীলীগ করেন তার কাছে আওয়ামীলীগের ভালো-মন্দ সবই ভালো। আর যিনি বিএনপি বা অন্য দল করেন তাঁর কাছে সরকারের ভালো জিনিসও খারাপ আর খারাপ জিনিসতো খারাপই। এই ধরনের কালচার আমাদের সমাজের রন্ধে রন্ধে রয়েছে। এগুলো হতে বেরিয়ে আসতে না পারলে কোনো উন্নতি হবে না। দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। উন্নয়ন ঘটেছে অনেক কিছুর কিন্তু তারপরও আমরা যেনো সেই তিমিরেই রয়ে গেছি। এইসব বিষয়গুলো আমাদের সব সময় নাড়া দেয়। আগে আমাদের নিজের দিকটি দেখতে হবে। আমি আগে নিজেকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরি করবো। তারপর অন্যকে উপদেশ দিবো যোগ্য নাগরিক হওয়ার জন্য। শুধু সরকারকে বা সরকারি দলকে দোষারোপ করে নিজে ভালো হলে দেশের কোনো উন্নতি হবে না। এক কথায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে দেশের জন্য। সকলের মধ্যে দেশপ্রেম আনতে হবে। দেশপ্রেম না থাকলে জাতির জন্য আমরা কিছুই করতে পারবো না। শুধু নিজের ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর মনমানষিকতা পরিহার করতে হবে।
যেমন রমজান এলে আমরা বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে দেখি জিনিসপত্রের দাম কমানো হয়। ছাড় দেওয়া হয় অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উপর। কিন্তু আমাদের দেশে কী ঘটে? রমজান এলে ৩০ টাকা কেজির বেগুন বিক্রি হয় ৮০ টাকা কেজিতে। যে টমেটো রোজার আগে বিক্রি হয়েছে ৩০ বা ৪০ টাকা কেজি তা রোজার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে ৭০ বা ৮০ টাকা কেজি দরে। এই অবস্থার অবসান দরকার। শুধু মুনাফার জন্য আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা পাগল হয়ে যান। তাই রাতারাতি পেঁয়াজের কেজি ২০/৩০ টাকা বেড়ে যায়। কখনও কখনও চিনির দাম ৪০ টাকা থেকে ৭০ টাকা হয়। এই অবস্থা সর্বক্ষেত্রে। তাই আমাদের আগে নিজেদের ঠিক হতে হবে। আগে আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম আনতে হবে। নিজের দিকটা না ভেবে দেশের সাধারণ মানুষের কথা ভাবতে হবে। তবেই আমাদের দেশের ও আমাদের সকলের উন্নতি ঘটবে, নইলে নয়।
আসুন আমরা নিজেকে পাল্টে ফেলি। শুধু নিজের কথা না ভেবে দেশের কথা ভাবি, দেশের মানুষের কথা ভাবি।