দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ভুটান এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি। ঘন সবুজে ঢাকা ভুটান শান্ত, নিরিবিলি এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন৷ এক অন্য আবেশ, অন্য অনুভূতির ওয়াংচুক রাজার দেশ এই ভূটান ৷ উপভোগ করার মতো অনেক কিছুই রয়েছে সাজানো-গোছানো এই দেশটিতে ৷ তাই ভ্রমণপিপাসুদের প্রথম পছন্দ এই ভূটান। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভুটান ভারতীয় উপমহাদেশে হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত। দেশটির উত্তরে চীনের তিব্বত অঞ্চল এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত। ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের পুরো দেশটাই পাহাড় দিয়ে বেষ্টিত। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার মতো সমতল কোন জায়গাই ভুটানে নেই। মাথাপিছু গড় আয় ১ হাজার ৫০ মার্কিন ডলার।
দেশে বড় কোনো শিল্পকারখানা নেই। লোকসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। আয়ের মূল উৎস বিদ্যুৎ, ফল ও পর্যটন। হিমালয়ের কল্যাণে উঁচু পর্বতমালা,ঘন বনজঙ্গল,সবুজ ভ্যালি এই ভূটানের প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্র্য। দেশটিতে রয়েছে দেজং (প্রাসাদদুর্গ), বৌদ্ধ মন্দির ও পর্বতের গায়ে অসংখ্য গুহা সেখানকার গৌরবময় প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। আর এই কারণে ভুটান এই অঞ্চলের অন্যতম পর্যটনসমৃদ্ধ দেশ। প্রকৃতির অকৃত্রিম মমতা এবং সবুজে ছাওয়া বিস্তৃত অঞ্চল পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। আগস্ট থেকে অক্টোবর এই তিন মাস ভুটানে বেড়ানোর উৎকৃষ্ট সময়। ভ্রমণের জন্য দেশটি বেশ নিরাপদ। পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের পছন্দের স্থানগুলোতে ঘুরতে পারেন। শান্তিময় ভ্রমণের জন্য ভূটান সকল পর্যটকের কাছে যেন এক স্বর্গরাজ্য।
১.থিম্পু
ভুটানের রাজধানী থিম্পু ৷ পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম রাজধানী শহর এটি। উচ্চতা ২৩০০ মিটার। চকচকে ঝকঝকে একটা শহর ৷ ওয়াং-চু উপত্যকার গা ঘেঁষে বসে আছে রাজধানীটি ৷ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে চু নদী ৷ ভূটানের সবথেকে আকর্ষণীয় এবং নান্দনিক সৌন্দর্যের আতুড়ঘর হলো এই থিম্পু। থিম্পু নদীর তীরে সিলভান ভ্যালিতে অবস্থিত এথনিক ভূটানিজ কলা, স্থাপত্যশিল্প, সংস্কৃতির পীঠস্থান। থিম্পু পৃথিবীর একমাত্র রাজধানী যেখানে রাজপথে কোনো সিগন্যাল বাতি নেই। পাহাড়ের উপর স্থাপিত ১৬৯ ফুট দীর্ঘ সোনার জল দিয়ে তৈরি বিশালাকার শখ্যমুনি বুদ্ধের মূর্তি শহরে বিভিন্ন জিায়গা থেকে দৃশ্যমান ৷ থিম্পুতে আরও যা রয়েছে : হ্যান্ডিক্রাফট এম্পোরিয়াম, ট্র্যাডিশনাল মেডিকেল ইন্সটিটিউট, পেন্টিং স্কুল এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরি।ঘুরে আসুন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তীর্থভূমি ভুটান. থিম্পু শহরের প্রাণকেন্দ্র হলো ১৬৬১ সালে নির্মিত এই থিম্পু জং। এখানে তাশিকো দেজং দালানটি দেশের প্রধান সচিবালয়। এখানে আছে সরকারি ডিপার্টমেণ্ট, দ্যা ন্যাশনাল এসেম্বলি, রাজার থ্রোন রুম এবং সেন্ট্রাল মনাষ্টিক বডির গ্রীস্মকালীন হেডকোয়ার্টাস। এছাড়া দেশের ধর্মীয় প্রধানদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
২. টাইগার নেস্ট
পারোর সব থেকে বড় আকর্ষণ টাইগার নেস্ট। জায়গাটি ধর্মীয় এবং পর্যটনের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মনাষ্ট্রি পারো থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে একটি ক্লিফের উপর অবস্থিত। হেঁটে ওঠার পথটিও খুব সুন্দর। তিন হাজার ফুট হেঁটে উঠতে হবে আবার নেমে আসতে হবে। পায়ে হাঁটার বিকল্প কোন ব্যবস্থা নাই। ভূটান ট্যুরিজম দর্শনার্থীদের গলা ভেজাতে এখানে একটি সুন্দর কফি হাউজ রয়েছে। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ ভুটানের এসব স্পট এতই বিখ্যাত যে কোন পর্যটকই এসব জায়গা সহজে মিস করতে চাননা। কাজেই আর দেরী কিসের জন্য? বাক্স-পেটরা গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়া যাক ওয়াংচুক রাজার দেশে আর উপভোগ করি প্রকৃতির আপন তুলিতে সাজানো ভূটানের নানা টুরিস্ট স্পট।
৩.পারো
ভুটানের অন্যতম আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থাপনার নিদর্শন হলো পারো । হিমালয়ের কোলে অবস্থিত ছোট্ট শহর পারো। পারো ভ্যালির উপর ধাপে ধাপে ধান চাষ হয় ৷ পারোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও ভোলার মত নয়। বিশেষ করে বসন্ত ঋতুতে পারোর রুপ হয়ে ওঠে অতুলনীয়। অবিরাম বয়ে চলেছে ধবধবে সাদা নদী আর মাথায় রয়েছে পরিষ্কার নীল আকাশ– ঠিক যেন লাল-নীল-সবুজের মেলা বসেছে । পারো থেকে সাইট সিইং এবং বেশ কয়েকটি গুম্ফা ছাড়াও রয়েছে পারো মিউজিয়াম, পারো জং। এসবই দেখবার মতো জায়গা৷
৪. চ্যালেলা পাস
পারো ভ্যালি থেকে দুই ঘণ্টার রাস্তা এই চ্যালেলা পাস । এই জায়গা এতটাই মনোমুগ্ধকর যে আপনি দৃষ্টি ফেরাতে পারবেন না। শীতে নদী ও ঝরনাগুলো জমে কাঁচের মত স্বচ্ছ হয়ে থাকে। পথের দুপাশে যেন রং বেরঙের ফুলের পসরা সাজানো রয়েছে । থেকে থেকে মৃদু গতিতে তুষার ঝরার ঘটনাও আপনাকে শিহরিত করবে। কথিত আছে এই পাস তার ভক্ত পর্যটকদের আহ্বান করে সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। পাসে দাঁড়িয়ে দেখা যায় পর্বতের সাদা চূড়া আর তার নিচে অপরূপ বিস্তীর্ণ উপত্যকা ভূমি।
৫. জিগমে দর্জি ন্যাশনাল পার্ক
ভুটানের সর্ববৃহৎ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অভয়ারণ্য হিসেবে এই পার্কের অবস্থান শীর্ষে। বিরল প্রজাতির ভুটানের জাতীয় ফুল ব্লু পপি পার্কের ভেতর প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়। রয়েছে ম্যাগনোলিয়া, জুনিপার্স ফুল এবং সচরাচর দেখা যায় না এমন বহু প্রজাতির অর্কিড। দৈত্যাকৃতির রুবার্ব এবং অতি পুরনো পাইন ও ওক গাছ রয়েছে প্রচুর। এই অভয়ারণ্যে প্রাণীর মধ্যে দেখা মেলে ভুটানের জাতীয় পশু টাকিন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে দেখতে পাবেন রেড পান্ডা, গোল্ডেন লাঙ্গুর, লেপার্ড এবং শ্বেত ভালুকসহ অন্যান্য প্রাণী।
৬. সিমতোখা জং
১৬২৭ সালে তৈরি এই জং থিম্পু ভ্যালির গেটওয়ে। থিম্পুর সবথেকে পুরনো এই জঙয়ে আছে রিগনে স্কুল ফর জঙঘা এ্যাণ্ড মোনাষ্টিক ষ্টাডিস। অন্যান্য আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে: ফ্রেশকো এবং স্টেট কার্ভিংস ।
৭. মেমোরিয়াল কর্টেন
এটি মূলত স্মৃতিস্তম্ভ। ভূটানের তৃতীয় রাজা জিগমে দরজি ওয়াঙচুকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৭৪ সালে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। এর ভেতরের রয়েছে নানারকমের পেইণ্টিং এবং স্ট্যাচু যা বৌদ্ধ দর্শনের প্রতিবিম্ব।
৮. থিম্পুর উইক এণ্ড মার্কেট
কেনাকাটার জন্য থিম্পুর মনোরম এবং আকর্ষণীয় জায়গা হলো থিম্পুর উইকএণ্ড মার্কেট । হস্তশিল্প ও অ্যান্টিক জুয়েলারির জন্য এই মার্কেট প্রসিদ্ধ। এছাড়া ভূটানের ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা কাপড়, কাঠের তৈরি জিনিসপত্র ও গালিচার সুনিপুণ কারুকার্য দেখে আপনার সৌখিন মন নেচে উঠবেই। পর্যটকদের উদ্দেশ্য করেই এখানে হস্তশিল্পের মেলা বসে। হেঁটে উপভোগ করার মত জায়গা এটি। ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন আকৃতির মুখোশ এখানকার অন্যতম আকর্ষণ।
৯. থাসিংগাং
এটি ভুটানের সর্ববৃহৎ জেলা। এখানকার দেজংগুলি ১৭ শতকে নির্মিত। থাসিংগাংকে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সন্ন্যাসীদের গুম্ফা নগরও বলা হয়। এই জায়গায় ভ্রমণে এলে আপনি লক্ষ করবেন কত নিবিষ্ট মনে ভিক্ষুগণ ধর্মচর্চায় নিজেদের নিমগ্ন রেখেছেন।
১০. পুনাখা
থিম্পু শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পুনাখা। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী সুনিপুণ কারুকার্যে শোভিত এই পুনাখা। আকাশ পরিস্কার থাকলে খুব সহজেই এখান থেকে হিমালয় দর্শন করতে পারবেন। ভুটানের সব থেকে উর্বর ভ্যালি এই পুনাখা। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পুনাখা জং, ফো ছু এবং মো ছু নদী । ফো চু (বাবা) ও মো চু (মা) নদীর পাশে লক্ষ্মী মেয়ের মতো সেজেগুজে থাকা পুনাখা বর্তমানে ভুটানের শীতকালীন রাজধানী। ওয়াং ডু উপত্যকার উপরে পুনাখা জং ৷ অতিকায় এই জং জুড়ে রয়েছে রাজকীয় স্থাপত্যশৈলী৷ জং-এর চারপাশে জ্যাকারান্ডা গাছ ৷ মার্চ-এপ্রিলে এই গাছ ফুলে ভরে থাকে৷
১১. বুমথাং
বুমথাংকে বলা হয় ভূটানের আধ্যাত্মিকতার হৃদয়ভূমি। কারণ, ভূটানের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জং, মন্দির এবং মহল এই অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে এলে দেখতে পাবেন ওয়াংগডিচোলিং প্যালেস, জাম্বে লাখাং মন্দির, এবং সবথেকে বড় ভূটানিজ মন্দির জাকার। একটু দূরেই অবস্থিত হট প্রিং এরিয়া। পথটা খুবই সুন্দর। এই এলাকায় বলু শিপ, মাস্ক ডিয়ার, হিমালয়ান ভাল্লুক চোখে পড়তে পারে।
কিছু তথ্য:
সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য ভুটানে যেতে ভিসার প্রয়োজন হয় না। কেবল টিকিট কাটবেন আর চলে যাবেন। দেশের একমাত্র বিমান বন্দর পারোতে অবতরণের সাথে সাথে পোর্ট এন্ট্রি দিয়ে আপনাকে তাদের দেশে স্বাগত জানানো হবে। দ্রুক এয়ারওয়েজ তাদের একমাত্র বিমান সংস্থা আর বাংলাদেশ থেকে কেবল দ্রুক এয়ারওয়েজেই সেখানে যেতে হবে। টিকিটের মূল্য প্রায় ২৩ হাজার টাকা। সড়ক পথে যাওয়ার পরিকল্পনা করলে প্রথমে ইন্ডিয়ান ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে। কারণ বাংলাদেশ থেকে আপনাকে ইন্ডিয়া হয়ে ভুটানে প্রবেশ করতে হবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ট্রানজিট ভিসা আবেদনের জন্য আবেদনপত্রের সঙ্গে ঢাকা-বুড়িমারী-ঢাকা ফিরতি বাস টিকিট জমা দিতে হবে। ঢাকা থেকে দৈনিক রাত সাড়ে আটটায় এস আর ট্রাভেলস (এসি) বাস বুড়িমারীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
আপনার ভ্রমণ যদি সড়ক পথে হয় তাহলে ঢাকা থেকে বুড়িমারী পৌঁছার পর সেখান থেকে অন্য আর একটি বাসে/সুমো জীপে জয়গাঁ সীমান্তে যেতে হবে। সেখানে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রবেশ করবেন ভুটানের ফুয়েন্টসোলিং এ। এরপর আপনার যাত্রা থিম্পু অথবা পারোর দিকে। কেবলমাত্র সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে সেখানে ব্যায়ের ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে ভুটানে অবস্থানকালে প্রতিদিন দুইশ ডলার ব্যায় করা বাধ্যতামূলক।