ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ বাংলাদেশের ইতিহাসে সেই নৃশংস, ভয়ংকর, মর্মান্তিক ও বিভীষিকাময় কালরাত আজ। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পৈশাচিক হিংসতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর। এ অভিশপ্ত রাতে পাক বাহিনীর বর্বরোচিত হামলায় প্রাণ হারায় শত শত দেশপ্রেমিক তরুণ, যুবক, আবালবৃদ্ধ-বনিতা। এদিন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। নরঘাতক পাক বাহিনীর পৈশাচিক উল্লাস, লুণ্ঠন, হত্যা ও নির্মম হিংস থাবায় ধ্বংস হয়েছিল বাড়িঘর, সম্পদ ও জনপদ। নারকীয় জিঘাংসায় তারা পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বসতবাড়িসহ হাজারও স্থাপনা। মানব জাতির ইতিহাসে এমন বর্বরতা এবং নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র হামলার দ্বিতীয় কোন নজির বিশ্বে নেই।
পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হামলা
সেদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশে রাত ১টায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুরো শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পিলখানার ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুমন্ত মানুষের ওপর। হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি চলতে থাকে লুটপাট, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ। একই সঙ্গে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় অন্যান্য বড় বড় শহরেও। রক্তপিপাসার কলংকজনক ইতিহাস সৃষ্টি করে সেদিনই মূলত পাকিস্তানের কবর রচনা করেছিল মানুষ রূপি জল্লাদ ইয়াহিয়া।
অপারেশন সার্চলাইট
নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর হামলার জন্য ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বিশ্বমানবতার ইতিহাসের এ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সমগ্র মানবজাতির কাছে ধিকৃত হয়। ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে স্থান হয় তাদের। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত গোটা বাঙালি জাতি এ মানবতাবিরোধী হামলায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েও ঘুমভাঙা চোখে মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দেশের সর্বত্র শুরু হয়ে যায় সশস্ত্র সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক আহ্বান ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’ মন্ত্র হূদয়ে ধারণ করে মাতৃভূমির স্বাধিকারের অদম্য আকাঙ্ক্ষায় বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্র, পরিবার ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয় বাংলার অকুতোভয় সূর্যসন্তানরা। সেদিন তারা হানাদার বাহিনীর সেই নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। দীর্ঘ ৪১ বছর পরও আজকের ঐতিহাসিক দিনটিতে বাংলার মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতি চরম ঘৃণা, ক্ষোভ ও ধিক্কারের মধ্য দিয়ে স্মরণ করছে।
স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঐতিহাসিক ঘোষণা
দিনটি যেমন অভিশপ্ত, তেমনি অবিস্মরণীয় উজ্জ্বল ইতিহাসের মাইলফলকও। ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহর তথা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, অসহযোগ আন্দোলনের একমাত্র কাণ্ডারি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঐতিহাসিক যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারই পথ বেয়ে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, প্রিয় মাতৃভূমি- বাংলাদেশ।
প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর ঢাকায় গোপন বৈঠকে
একাত্তরের ২৫ মার্চ সকালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। ভুট্টো বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাবে জানান, ‘পরিস্থিতি সংকটজনক’। বৈঠকের পর থেকেই ঢাকায় সেনাবাহিনী নামার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সকাল থেকে সারাদিনই হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে সমবেত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বেশ কয়েকবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে বলেন- ‘আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী। এ অবস্থায় আমাদের পথ আমাদেরই দেখতে হবে। সবাইকে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’
সেদিন ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠক করেই জেনারেল ইয়াহিয়া গোপনে বৈঠক করেন ইস্টার্ন জোনের সামরিক প্রধান লে. জেনারেল টিক্কা খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, মেজর জেনারেল মিঠ্ঠা খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারের সঙ্গে। সেখানেই তিনি সব ধরনের মানবিক রীতি-নীতি লংঘন করে বাংলার স্বাধিকারের জন্য আন্দোলনরত গণমানুষের ওপর সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সর্বাত্মক আক্রমণ ও নির্বিচার গণহত্যা চালাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। বাঙালি গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর বাস্তবায়ন কর্মসূচিও অনুমোদন হয় ওই বৈঠকে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এদিন বেলা ১১টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারযোগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মে. জেনারেল জানজুয়া, মে. জেনারেল মিঠ্ঠা খান, মে. জেনারেল নজর হোসেন শাহ ও মেজর জেনারেল ওমরসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা রংপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সেনানিবাস সফর করে প্রতিটি স্থানেই শুধু পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন। প্রতিটি বৈঠকে তারা গণহত্যার নীলনকশা সংবলিত একটি করে খাম হস্তান্তর করেন কমান্ডিং অফিসারদের হাতে।
২৫ মার্চের বিদায়ী সূর্যের রক্তিম আভা মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে ভেসে আসতে থাকে সর্বনাশের গন্ধ। সমগ্র জাতি তখন স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ তখন এতটাই প্রবল যে, পাকিস্তানি সুসজ্জিত ও দুর্ধর্ষ সামরিক বাহিনীকেও তুচ্ছজ্ঞান করছে সবাই। কেউ পাক বাহিনীর আক্রমণের প্রচণ্ডতা ও বীভৎসতা সম্পর্কে আঁচও করতে পারেনি। এদিন সকালেই রেডিও এবং টেলিভিশন ভবনের সামনে ট্যাংক নিয়ে অবস্থান নেয় সেনাবাহিনী। সকাল থেকেই বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তির সূতিকাগার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ৬৬৭ নম্বরের বাসাটির সামনের চত্বর লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। সারাদিন ধরে চলতে থাকে রাজনৈতিক শলাপরামর্শ। বিকাল ও সন্ধ্যা থেকেই বঙ্গবন্ধু ভবনকে ঘিরে বিভিন্ন রাস্তায় শুরু হয় ব্যারিকেড।
এভাবেই সেদিন ২৫ মার্চ রাতে বাঙালি জাতির উপর পাক হানাদার বাহিনী সশস্ত্র হামলা চালায়। এর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেনি। তারা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই কথা স্মরণ করে ঝাপিয়ে পড়েছিল শত্রুর মোকাবেলা করতে। যার সমাপ্ত করেছিল এদেশের আপামর জনতা ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যমে। তাই এই দিনটি বাঙালি জাতির জন্য একটি অবিস্মরণীয় দিন।