দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগর সংলগ্ন সমুদ্রে এমন এক উপজাতির বসবাস যারা তাদের জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটিয়েছেন সাগরে। পানির নিচে ডুবে থাকার অবিশ্বাস্য ক্ষমতার অধিকারী হলো এই উপজাতি!
এই বিশেষ উপজাতির নাম হলো বাজাউ উপজাতি। তাদের রয়েছে একটি বিরল যোগ্যতা বা ক্ষমতা। আর সেটি হলো, অবিশ্বাস্যভাবে তারা পানির নিচে প্রায় ১০ হতে ১৩ মিনিট শ্বাস ধরে থাকতে সক্ষম, যা বিশ্বের অন্য কোনও উপজাতির মানুষরা কখনও পারে না।
সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়, সাগরে কাটানো এই যাযাবর জাতির সামুদ্রিক জীবন যাপনের নেপথ্যে যে জিনিসটি রয়েছে তা হলো একটি রূঢ় বাস্তবতা। প্রায় হাজার বছর পূর্বের কথা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোহর রাজ্যের রাজকন্যা দায়াং আয়েশাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সুলু রাজ্যের রাজার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য। তাই জোহরের রাজার বিশাল রাজকীয় নৌবহর যাচ্ছে সমুদ্র পথে। সেই কয়েকশো নৌকার বহর। রাজকন্যাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছে বাজাউ নামের এক উপজাতি। যারা এই এলাকার সমুদ্রকে নিজের হাতের তালুর মতোই চেনে ও জানে।
ব্রুনাইয়ের তৎকালীন সুলতান পূর্বেই আয়েশাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। তবে জোহরের রাজা তার মেয়ের সঙ্গে ব্রুনাইয়ের সুলতানকে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। এমন অপমান ভুলতে পারেননি ব্রুনাইয়ের সুলতান। সুলুর রাজার সঙ্গে আয়েশার বিয়ে তিনি কোনো মতেই মেনে নিতেও পারেননি। তাই অন্য কৌশল অবলম্বন করলেন সুলতান। আরও বড় নৌবহর নিয়ে এসে জোহর রাজ্যের নৌবহরকে অতর্কিতে আক্রমণ করলেন তিনি। গভীর সমুদ্রে তুমুল লড়াইয়ের পর ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন জোহরের সেই রাজকন্যাকে।
দেশে ফিরেই রাজকন্যাকে বিয়ে করলেন ব্রুনাইয়ের সুলতান। বিপদে পড়লেন কয়েকশ’ বাজাউ এবং তাদের পরিবার। দেশে ফিরলেই জোহরের রাজা হত্যা করবেন। প্রাণের ভয়ে তারা দেশে ফিরতে পারেননি। স্থলের সঙ্গে তাদের চিরকালের জন্য বিচ্ছেদও হয়ে যায়। সমুদ্রই হয়ে যায় তাদের ঘর-বাড়ি। ঘুরতে থাকে বাজাউরা বিভিন্ন সাগরে উপসাগরে, দেশহীন যাযাবরের মতোই।
এখনও সমুদ্রেই বাজাউরা
সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বাজাউ-লাউটরা। আজও তাদের পুরো জীবন কাটে সমুদ্রে। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াকে ঘিরে বেশ কয়েকটি উপসাগর বিদ্যমান। যাদের নাম সুলু, সেলেবিস, বান্দা, জাভা, মালুকু, ফ্লোরেস ও সাভু। এই উপসাগরগুলোর নীল পানিতে ঘুরে বেড়ান বাজাউরা, তাদের বিশেষ আকৃতির নৌকার নাম হলো লেপা। নির্দিষ্ট কোনও ঠিকানা নেই তাদের। তাই তাদের বলা হয় ‘সি জিপসি’ কিংবা ‘সি নোম্যাড’।
সমুদ্রের অগভীর পানিতে বাজাউদের অস্থায়ী বসতি
সমুদ্রের অগভীর এলাকাতে, তীর থেকে অর্ধ কিলোমিটার সমুদ্রের ভেতরে বাজাউরা তৈরি করেন তাদের অস্থায়ী গ্রাম। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা বাড়িগুলো কয়েক ঘন্টার মধ্যে খুলে ফেলা সম্ভব। এইসব বাড়িগুলোর নীচ দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ বয়ে যায়।
কেও কেও আবার নৌকাতেই থাকে জন্ম হতে মৃত্যু অবধি পর্যন্ত। শুনতে অবাক লাগলেও এটিই সত্যি, এই উপজাতির অনেক মানুষ রযেছে যারা মাটিতে কোনওদিন পাও রাখেনি। রাখবেই কী করে। নিজের দেশ নেই, নাম শুনলেই পুলিশ তাড়া করে এদের।
জানা যায় যে, বাজাউরা নাকি নিজেদের বয়সও বলতে পারে না। এই যুগেও তারিখ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। ঠিক যেমন তারা জানে না বিদ্যুৎ কী ও কেনো লাগে। সমুদ্র তীরবর্তী কিছু সহৃদয় গ্রাম এদের জ্বালানী কাঠ এবং পানি ও জামা কাপড় দেয়। বিনিময়ে বাজাউরা তাদের দেয় মাছ।
বাজাউরা তিমি এবং ডলফিনের মতোই ডুবুরী
এক তথ্যে জানা যায়, অত্যন্ত শান্ত ও আমুদে এই উপজাতিটি সম্পূর্ণ সামুদ্রিক খাবারের ওপরেই বেঁচে থাকে। বছরের বেশিরভাগ সময় তাদের সমুদ্রের নিচে নামতে হয় খাদ্য সংগ্রহের জন্যই। তাই প্রত্যেকটি বাজাউ পুরুষ এবং নারী অবিশ্বাস্য মানের ডুবরী। শিশুরাও পানির নিচে সমানভাবে চলতে পারে। এমনকি খেলা করতেও সমুদ্রের পানিতে নামে তারা।