দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে রায়ে আদালত বলেছে, তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ৭টির মধ্যে ৫টিতে প্রমাণিত হওয়ায় আদালত ৩টিতে মৃত্যুদণ্ড, ১টিতে যাবজ্জীবন ও ১টিতে জেল দেন।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আজ এক রায়ে এ দণ্ডাদেশ প্রদান করেন। গত ৫ জুন মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শেষে রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল। মুজাহিদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ৭টি অভিযোগ।
আজকের রায় হলো বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন এবং বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারক শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর টি চতুর্থ রায়।
শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনকে অপহরণের নির্দেশ প্রমাণিত হয়েছে। ২নং অভিযোগ সত্য তবে প্রমাণিত হয়নি। ৩নং অভিযোগের দায়বদ্ধতা রয়েছে। ৪নং অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ৫, ৬ ও ৭ নং অভিযোগ প্রমাণিত।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত পাঁচটি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে জামায়াতে ইসলামীর বহিষ্কৃত রুকন পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। আর জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের ৯০ বছর ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। বর্তমানে দুই ট্রাইব্যুনালে আরো পাঁচজনের বিচার প্রক্রিয়া চলছে।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
মুজাহিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মোট সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, সাধারণ মানুষ হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও দেশত্যাগে বাধ্য করা ইত্যাদি। মুজাহিদ একক ও দলবদ্ধভাবে সরাসরি জড়িত থেকে ও নেতৃত্ব দিয়ে কিংবা সহযোগিতা ও নির্দেশ দানের মাধ্যমে এসব ঘটনা ঘটান বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। অভিযোগগুলো নিচে তুলে ধরা হলোঃ-
অভিযোগ-১ : এ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগ থেকে ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ করা হয়। মুজাহিদের পরিচালনাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন ৭-৮ জন যুবক তাকে ধরে মিনিবাসে তুলে নেয়। এ পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩(২) (এ) (জি), ৪(১) এবং ৪(২) ধারায় বর্ণিত অপরাধ করেছেন মুজাহিদ। ওই আইনের ২০ ধারায়ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটন করেছেন তিনি।
ওই সময় শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি নিজ পত্রিকায় ভাষ্যকার পরিচয়ে ‘ঠগ বাছিতে গা উজাড়’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ লিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এদেশি এজেন্টদের বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর হয়রানির চিত্র তুলে ধরেন। ওই প্রবন্ধ প্রকাশের পর জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ‘অতএব ঠক বাছিও না’ শিরোনামে পাল্টা প্রবন্ধ ছাপা হয়। প্রবন্ধটিতে সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে সমালোচনা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ৩টায় সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনের ৫ নম্বর চামেলীবাগের ভাড়া করা বাসায় রাইফেলধারী ৭-৮ যুবক তাকে ধরে নিয়ে যায়। এযাবত তার লাশেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ-২ : দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে- একাত্তরের মে মাসে একদিন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নেতৃত্বে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানায় বিভিন্ন গ্রামে হিন্দুদের প্রায় তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা। পরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন হিন্দু নরনারীকে হত্যা করে। যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩ (২) (এ) (সি) (জি) এবং ৪ (১) ধারায় অপরাধ সংঘটিত করেছেন তিনি।
অভিযোগ-৩ : তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে যেকোনো একদিন ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট (রথখোলার) মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের পুত্র রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে। বেলা অনুমান ১১টার দিকে ফরিদপুর পুরনো সার্কিট হাউসে আসামি আলী আহসান মুজাহিদের সামনে পাকিস্তানি সেনা অফিসার মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে হাজির করা হয় বাবু নাথকে। তখন মুজাহিদ ওই মেজরের সঙ্গে কথা বলার পর বাবু নাথের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তার একটি দাঁত ভেঙে ফেলা হয়। নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাকে হত্যা করার উদ্দেশে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আব্দুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে রাজাকাররা আটকে রাখে। পরে রাতে রণজিৎ নাথ বাবু তার আটক ঘরের জানালার শিক বাঁকা করে ওই ঘর থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচান।
অভিযোগ-৪ : চতুর্থ এ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৬ জুলাই সকাল বেলায় ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থেকে স্থানীয় রাজাকাররা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখি, পিতা- মৃত মো. জয়নাল আবেদীন, গ্রাম-পূর্ব গোয়ালচামট খোদাবক্সপুর, থানা- কোতোয়ালি, জেলা- ফরিদপুরকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করা হয়। এরপর পাখিকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক করা হয়। আটক বন্দিদের মধ্যে আবু ইউসুফ পাখিকে দেখে মুজাহিদ সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি মেজরকে কিছু একটা বলার পরই তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। সেখানে ১ মাস ৩ দিন আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নির্যাতনের ফলে আবু ইউসুফ পাখির বুকের ও পিঠের হাড় ভেঙ্গে যায়।
অভিযোগ-৫ : পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাত ৮টায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামীসহ ঢাকার নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যান। সেখানে তারা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালিগালাজ করেন এবং পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন যে, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আদেশের আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। আসামি মুজাহিদ অন্যদের সহায়তায় আটকদের একজনকে ছাড়া অন্যান্য নিরীহ-নিরস্ত্র বন্দিদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।
অভিযোগ-৬ : ষষ্ঠ অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারাও ওই স্থানে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ অপরাধজনক নানা কর্যক্রম চালায়। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র মাধ্যমে আসামি আলী আহসান মোহামদ মুজাহিদ ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযানসহ সারা বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীসহ হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদিসহ যাবতীয় মানবতবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা সংঘটিত করেন।
অভিযোগ-৭ : সপ্তম অভিযোগে বলা হয়েছে- একাত্তরের ১৩ মে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে। শান্তি কমিটির বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বকচর গ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হামালা চালিয়ে বীরেন্দ্র সাহা, উপেন সাহা, জগবন্ধু মিস্ত্রি, সত্য রঞ্জন দাশ, নিরদবন্ধু মিত্র, প্রফুলস্ন মিত্র, উপেন সাহাকে আটক করা হয়। উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকা দিয়ে তার স্বামীর মুক্তি চান। রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝুমা রাণীকে ধর্ষণ করে। পরে আটক হিন্দু নাগরিকদের হত্যা করে। তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অনিল সাহাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়।