ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দিনকে দিন এতই নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে যে কোনভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য এই পরিস্থিতি হয়েছে বলে অনেকে মত দিয়েছেন।
কাটাবনের এক ফটোকপি ব্যবসায়ী জানান, বিদ্যুতের জন্য সারাদিন যেভাবে কাজ করতে হচ্ছে তাতে কর্মচারিদের বেতন ও দোকান ভাড়া দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের উচ্চ মূল্যের জন্য এমনিতেই ব্যবসা চালানো আমাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তারওপর সারাদিন ৩/৪ বার বিদ্যুতের লোড শেডিং, এভাবে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া ছাড়া কোন গত্যান্তর নেই। তিনি মন্তব্য করেন, এভাবে কোনদিন দেশ চলতে পারে না।
মূল্যস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না কিছুতেই
কিছুতেই যেনো মূল্যস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না। খাদ্য বাদে অন্য খাতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি হিসাবে মার্চে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০.১ শতাংশ। গত বছরের মার্চে যে পণ্যের দাম ছিল ১০০ টাকা এখন এ বছরের মার্চে গড়ে ওই পণ্যের দাম ১১০ টাকা ১০ পয়সা। এক বছরের গড় মূল্যস্ফীতি ১০.৯২ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে এই হার ছিল ৮.৩৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ৫ এপ্রিল মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ এ তথ্য প্রকাশ করেছে। সংস্থার হিসাবে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশ হবে বলে ধরা হয়েছিল। আর এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়কালে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ভোক্তা ঋণ কমানো এবং বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভুল পথে চলছে সরকার। কারণ বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশে ডলারের দাম বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাদের মতে, সরকারকে কেতাবি চিন্তা-ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ভর্তুকি কমাতে হবে। এছাড়া রাজস্বনীতির সঙ্গে মুদ্রানীতির সমন্বয় করতে হবে।
মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ প্রতিবেদন
মাসভিত্তিক হিসাবে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে এসেছে। কিন্তু খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ১৩.৯৬ শতাংশে পৌঁছেছে। এ খাতে এটাই মূল্যস্ফীতির রেকর্ড। এদিকে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০.১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে যা ১০.৪৩ শতাংশ ছিল। বিবিএসের মহাপরিচালক শাজাহান আলী মোল্লা জানান, মার্চে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছিল ৮.২৮ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৮.৯২ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত খাতে মার্চে ১৩.৯৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে যার হার ছিল ১৩.৫৭ শতাংশ। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে চাল, ডাল, মসলা ও ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। অন্যদিকে খাদ্যবহির্ভূত খাতে প্রধানত পরিধেয় বস্ত্র, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন, আসবাবপত্র ও গৃহস্থালি এবং লন্ড্রি সামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। তিনি আরও জানান, ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। আগের বছর একই সময়ে যা ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ ছিল। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশ হবে বলে ধরা হয়েছে।
যে কারণে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমছে
খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কম হলেও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এর পেছনে সরকারের কোন কৃতিত্ব নেই। কারণ দেশে বাম্পার ফলন হওয়ায় চাল, ডাল, গমসহ খাদ্যপণ্যের আমদানিনির্ভরতা কমেছে।
অর্থনীতিবিদরা যা মনে করেন
একটি দৈনিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, বাজেটে যে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, বাস্তবে তা সম্ভব নয়। অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে থাকবে। তিনি বলেন, মুদ্রানীতি নিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তার মতে, ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমানো হলে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। কারণ টাকার দাম কমানো হলে আমদানিনির্ভর পণ্যের খরচ বেড়ে যায়। উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারম্যান রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার ভুলনীতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশে রফতানির চেয়ে আমদানি বেশি। তাই এদেশে ডলারের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে। তার মতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ পেতে সরকার জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। সংস্থাটির যেসব শর্ত সরকারকে মানতে হয়েছে, মূল্যস্ফীতিতে তার প্রভাব পড়েছে।
গত বছরের মার্চে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজেটে পৌঁছায়। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ১০.৮ শতাংশ, ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় নভেম্বর মাসে ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ১২.৭ শতাংশ এবং ১৯৯৫ সালের জুলাইতে ১১.৪ শতাংশ হারে ডাবল ডিজেটের মূল্যস্ফীতি হয়েছিল।
বিষয়গুলোর দিকে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট মহলের বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। নইলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে দিনকে দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে-ভবিষ্যতে দেশ এক নাজুক পরিস্থিতিতে উপনিত হবে- যা কারই কাম্য নয়।