ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ সুন্দরবন এলাকায় জলদস্যুদের উৎপাতে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। এই জলদস্যুরা জেলেদের অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না।
জানা গেছে, গোটা সুন্দরবন ঘেঁষা বিশাল উপকূল ও নোয়াখালীর হাতিয়ার চরাঞ্চলের জল এবং বনদস্যুদের কোনভাবেই দমন করতে পারছে না আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সব দস্যু বছরের পর বছর একদিকে জেলেদের অপহরণ ও চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে বিশাল বনাঞ্চলের মূল্যবান গাছ কেটে বন উজাড় করে ফেলছে। ইলিশের ভরা মৌসুমে দস্যুরা আবার বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা সাগরে ব্যাপক চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে।
সূত্র মতে, গত দুই বছরে দুই হাজার কিলোমিটারজুড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে অন্তত এক হাজার জেলেকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়। এ সব জেলে চাহিদামতো মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। এ সময় দস্যুদের চাহিদা মতো চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় অর্ধশত জেলেকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অন্যদিকে গত দুই বছরে র্যাব ও কোস্টগার্ডসহ আইন-শৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে অন্তত ২৫ দস্যু প্রাণ হারিয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, র্যাবের বিভিন্ন অভিযানের সময় বন্দুকযুদ্ধে কয়েকজন দলনেতাসহ বেশ কয়েকজন দস্যু নিহত হয়। বর্তমান ইলিশ মৌসুমে উপকূলের জেলেদের ওপর দস্যুদের কিছু ক্ষেত্রে নির্যাতন চলছে। র্যাব কর্মকর্তা জিয়া বলেন, ওই সব এলাকায় দ্রুত অভিযান চালাতে স্পিডবোট থাকা খুবই দরকার। কিন্তু র্যাবের কাছে তা নেই। সমপ্রতি র্যাব এক বিশেষ অভিযান চালিয়ে সুন্দরবনের একটি কুখ্যাত গ্রুপের প্রধানসহ কয়েকজন বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়। সে সময় টিভি ক্যামেরায় এসব যুদ্ধের সচিত্র প্রতিবেদনও দেখা যায়। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে জলদস্যুরা ।
আইন-শৃংখলা বাহিনী সূত্র বলছে, বিশাল চরাঞ্চলজুড়ে ছোট-বড় অন্তত অর্ধশত জল ও বনদস্যুর গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। প্রত্যেক বছর ইলিশের মৌসুমে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠে। জনবল ও আধুনিক সরঞ্জামাদির অভাবে কোস্টগার্ড তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। চলতি বছরে র্যাব ও কোস্টগার্ডের কয়েকটি বড় ধরনের যৌথ অপারেশনের পর কিছু দিন এ সব দস্যু বাহিনী তাদের গুটিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আইন-শৃংখলা বাহিনী নিয়মিত কিংবা টানা অভিযান না চালানোর সুযোগ নিয়ে দস্যুরা আবার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের আশপাশের থানার বেশ কিছু পুলিশ সদস্য ও বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে রয়েছে দস্যুদের সখ্য। এ সব পুলিশ ও বনবিভাগের লোকজন দস্যুদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নেয় বলেও বলে অভিযোগ রয়েছে। চলতি জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বাগেরহাটের শরণখোলার ধানসাগর স্টেশন সংলগ্ন শেলা নদী থেকে ১৮ জেলেকে অপহরণ করে গহিন জঙ্গলে নিয়ে যায় জলদস্যু রেজাউল বাহিনীর সদস্যরা। তাদের প্রত্যেকের কাছে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে ১০ হাজার করে টাকা দিয়ে তারা দস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান। সূত্র জানায়, শুধু রেজাউল ওরফে শিষ্য বাহিনী নয়, সুন্দরবন উপকূলজুড়ে বিশাল সাগরে অন্তত অর্ধশত দস্যুবাহিনী বিচরণ করছে। তারা গভীর সাগরে জেলেদের নৌকায় হানা দিয়ে সব কিছু লুটে নিচ্ছে।
একই অবস্থা নোয়াখালীর হাতিয়া চরাঞ্চলে। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই বিশাল উপকূলের কোথায়ও না কোথাও দস্যুরা জেলেদের জিম্মি করে চাঁদাবাজি ও লুটতরাজ করছে। আইন-শৃংখলা বাহিনী সূত্র জানায়, সুন্দরবন উপকূল অঞ্চলে বেশ কিছু দস্যু বাহিনী থাকলেও এক সময় মূলত রাজত্ব করত বন ও জলদস্যু রাজু, জুলফিকার, মোতালেব, মান্নান ও মানিক। কিন্তু র্যাব ও কোস্টগার্ডের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে রাজু, মোতালেব ও মানিকসহ বেশ কয়েকজন সহযোগী নিহত হয়। বাহিনী প্রধানরা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্বে থাকা দস্যুরা আবার বাহিনীকে সংগঠিত করে দস্যুতা চালিয়ে যায়। আর ছোট দলগুলো ১০-১৫ জন দস্যু নিয়ে গঠিত হচ্ছে। তারা নিজ নিজ এলাকায় জেলেদের ওপর চালাচ্ছে নানা নির্যাতন। এখনও রাজত্ব চালাচ্ছে জুলফিকার বাহিনী। গোয়েন্দা সূত্র মতে, জুলফিকার বাহিনী ওরফে জুলফু বাহিনীর ক্যাডার সংখ্যা প্রায় ১০০-১২০ জন।
কোস্টগার্ডের গোয়েন্দা শাখার উপ-পরিচালক কমান্ডার এমএআই খান সাংবাদিকদের বলেন, দুই হাজারেরও বেশি কিলোমিটার এলাকাজুড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোস্টগার্ডের মাত্র দুই হাজার সদস্য কাজ করছে। তিনি বলেন, উপকূলে জেলেসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত ও দস্যুদের দমন করার জন্য প্রয়োজন হেলিকপ্টার ও স্পিডবোট। তাহলেই দস্যু বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।
আশা করা হচ্ছে, সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা উপকূলে জেলেসহ অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হেলিকপ্টার ও স্পিডবোটসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহের মাধ্যমে জলদস্যুদের দমনে সমর্থ হবে। জেলেদের নিরাপত্তা ও বন উজাড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে যা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।