ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্রভাবে সমালোচিত হচ্ছেন লাশ দাফন বিতর্কে তার কথিত ভূমিকার জন্য। যারা নিজেকে হুমায়ূনের বিশাল ভক্ত হিসেবে দাবি করছে, আজ তারাই হুমায়ূনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে কুৎসিততম মন্তব্য করে যাচ্ছে। যা কারো কাছেই কাম্য হতে পারে না।
সাত বছর আগে বিয়ে হলেও তাদের প্রেম, বিয়ে এবং এর পরিণামে হুমায়ূন আহমেদের আগের সংসার ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে এখন নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠেছে ফেসবুকে, বিভিন্ন ব্লগে এবং অন্যান্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে।
সম্পর্কিত বিষয়
কিন্তু যেভাবে মেহের আফরোজ শাওন সোশ্যাল মিডিয়ায় কথিত হুমায়ূন ভক্তদের সমালোচনার টার্গেটে পরিণত হয়েছেন, এবং যে ভাষায় তার এই সমালোচনা করা হচ্ছে-সেটা কতোটা ন্যায্য এবং যৌক্তিক সে প্রশ্ন উঠেছে। “ভাবতে আশ্চর্য লাগছে, যারা নিজেকে হুমায়ূনের বিশাল ভক্ত হিসেবে দাবি করছে, আজ তারাই হুমায়ূনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে কুৎসিততম মন্তব্য করে যাচ্ছে। শাওন মিথ্যা না সত্য বলছে, সে অভিনেত্রী না ভালোমানুষ, তাকে ব্যক্তিগতভাবে না জেনে, না চিনে মন্তব্য করার অধিকার আমাদের কে দিয়েছে”- ফেসবুকে তার স্ট্যাটাসে মুনমুন শারমিন শামস নামের একজন এভাবেই তার ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
পারিবারিক মূল্যবোধ
হুমায়ূন আহমেদ মূলত লিখেছেন বাংলাদেশের নাগরিক মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে। নিজের লেখায় যৌনতার খোলামেলা বর্ণনা তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন, এবং তার অনেক গল্পেই শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের পারিবারিক মূল্যবোধেরই জয় দেখানো হয়েছে।
কিন্তু এই জনপ্রিয় লেখক নিজেই যখন প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তিরিশ বছরের সংসার ভেঙে মেয়ের বান্ধবী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন, তখন স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন তার ভক্তরাও। কিন্তু সেই বিতর্কও এক সময় থিতিয়ে এসেছিল। নিজের লেখালেখি, টেলিভিশন নাটক এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ তার ভক্তদের মাতিয়ে রেখেছেন।
কিন্তু মৃত্যুর পর জনপ্রিয় এই লেখকের সাহিত্য কীর্তির মূল্যায়নের চাইতে তার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনই গণমাধ্যমে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি আলোচিত হচ্ছে। কোথায় হুমায়ূন আহমেদকে দাফন করা হবে তা নিয়ে যেভাবে পরিবারের সদস্যরা প্রকাশ্য মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েন, তা যে এই বিতর্ককে নতুন করে উস্কে দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
‘নারী সবসময় ভিকটিম’
প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের সংসার ভাঙার জন্য অনেকে দুষছেন মেহের আফরোজ শাওনকে। কোথায় হুমায়ূন আহমেদকে দাফন করা হবে, সেই দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত শাওন যেভাবে জয়ী হন-সেটাকেও লেখকের উত্তরাধিকার কব্জা করার প্রয়াস হিসেবে দেখেছেন অনেকে।
কিন্তু মেহের আফরোজ শাওনের ওপর এই আক্রমণের মধ্যে সমাজের সনাতনী পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীরই প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করছেন অনেকে। “ফেসবুকে এবং ব্লগে যে ভাষায় মেহের আফরোজ শাওনের সমালোচনা করা হচ্ছে তাতে হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তাকে অবমাননা করার একটা চেষ্টা খুবই স্পষ্ট”, বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক।
“অনেকে আবেগের জায়গা থেকে এমন কিছু কথা বলছেন, লিখছেন যা খুবই অনভিপ্রেত। বিশেষ করে এখানে শাওনকে ডেমোনাইজ করার একটা চেষ্টা চলছে। এমনকি হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর জন্যও তাকে দায়ী করে নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলা হচ্ছে। মেহের আফরোজ শাওনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর এই প্রবণতা খুবই হতাশাজনক। এটা খুবই অবমাননাকর।”
একজন নারী তার স্বামীর চিকিৎসার জন্য সূদুর ভিনদেশে পাড়ি দিলেন। দীর্ঘ ৯ বা ১০ মাস তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। তারপরও তাকে দোষারোপ করা যায় না। এমনও দেখা গেছে, প্রথম যখন হূমায়ুন আহমেদ অসুস্থ্য হলেন তখন লণ্ডনে গিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। যেমন আর্থিক সমস্যা। একটি ফেইস বুকে একটি ভিডিও ডকুমেন্ট থেকে বোঝা যায়। ওই ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, হূমায়ুন আহমেদের সামনেই শাওন বলছেন, হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে তাকে নিয়েই যে অর্থের কথা বলা হয় তা এক কোটিরও ওপরে। ওই কম সময়ে এতো টাকা কিভাবে সে পাবে সে নিয়ে চিন্তায় শাওন কান্না-কাটি শুরু করেন। পরে যেভাবেই হোক ম্যানেজ হয়েছে। এভাবে বহু কষ্ট করে ত্যাগ শিকার করে স্বামীর চিকিৎসা করিয়েছেন শাওন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন বলেন, এ ধরণের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সমাজে সবসময় নারীকেই দোষারোপ করার একটা প্রবণতা দেখা যায়।
“একজন পুরুষের সম্পৃক্ততা না থাকলে একজন নারী তার জীবনে জড়িয়ে যায় না। কিন্তু বিষয়টাকে আমরা সেভাবে দেখি না। একটা মেয়ে ঘর বাঁধলেও মুশকিল, না বাঁধলেও মুশকিল। ঘর টেকাতে না পারলে তার দায়ও মেয়েদের ওপরই আসে। আমাদের দেশে নারী সবসময়েই ভিকটিম।”
মাহবুবা নাসরীন বলেন, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যখন বিয়ে হয়, তখন শাওন তো বয়সে অনেক ছোট ছিলেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তো অনেক ম্যাচিউরড অবস্থা থেকে এই কাজটা করেছেন। কিন্তু কেও তো হুমায়ূন আহমেদকে ইঙ্গিত করে কিছু বলছেন না। ইঙ্গিত করা হচ্ছে তার স্ত্রী শাওনের প্রতি।”
শাওন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হূমায়ুন আহমেদের একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন। এটা আমরা কেওই অস্বীকার করতে পারবো না। আর তাই আমাদের প্রিয় এই লেখককে শ্রদ্ধা করতে হলে শাওনকে নিয়ে বিতর্ক থেকে আমরা অবশ্যই বিরত থাকবো।