দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে পশু জবাইয়ের নীতিমালা থাকলেও নীতিমালা বহির্ভূতভাবে জবাই করা হচ্ছে গরু-ছাগল যে কারণে মাংসের মান নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আসলে মাংসের নামে আমরা কি খাচ্ছি ? এ প্রশ্ন সচেতন সকলের।
পশু জবাইয়ের নিয়ম
# প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পশু জবাই ও মাংস পরীক্ষা নীতিমালায় বলা হয়েছে, জবাইখানায় পশু রাখার শেড থাকতে হবে।
# সেই শেড শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হতে হবে এবং ঝুলিয়ে গরুর চামড়া ছাড়াতে হবে যাতে মাটি স্পর্শ করতে না পারে।
# কমপক্ষে তিন দিন পশু রেখে ডাক্তারি পরীক্ষায় সার্টিফিকেট মিললেই জবাইয়ের জন্য নেওয়া হবে।
# চাকু দিয়ে চামড়া তোলা যাবে না, পুলিং চেইন ব্যবহার করতে হবে।
# জবাই করার পর মাংস কুলিং অবস্থায় আট থেকে ২৪ ঘণ্টা রাখতে হবে যাতে মাংসের ওপর চর্বির কোটিং পড়ে। এতে মাংস জীবাণুমুক্ত থাকবে।
# প্রসেসিং রুমে প্যাকেটিং করার আগে ভেটেরিনারি সার্জন পয়জন ও অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য পরীক্ষার পর সার্টিফিকেট দেবেন এটা বাজারজাত হবে কি না।
# বাজারজাতের উপযুক্ত হলে সিলম্যান গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়ার জন্য আলাদা আলাদা সিল দেবেন।
# সিটি করপোরেশনের চার্জ হিসেবে গরুর জন্য ৫০ টাকা, মহিষের জন্য ৭৫ টাকা, ছাগল/ভেড়ার জন্য ১০ টাকা করে দিতে হবে।
# প্রত্যেক জবাইখানায় আট ঘণ্টা হিসেবে প্রতি শিফটে একজন ভেটেরিনারি ডাক্তার, হুজুর, পরিদর্শক, সিলম্যান এবং ক্লিনার থাকবে।
এভাবে পশু জবাই হলেই কেবল স্বাস্থ্যসম্মত মাংস পাওয়া যাবে। জানা গেছে, এ নীতিমালার শর্ত মেনেই জবাই স্ল্যাবের ইজারাদার ইজারা নেন।
আইনে কি বলা আছে
সরকার অনুমোদিত জবাইখানার বাইরে এবং সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া পশু জবাই করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিধান রেখে পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ বিল ২৪ আগস্ট ২০১১ পাস করা হয়। এ বিলে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিক্রির জন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জবাইখানার বাইরে পশু জবাই করতে পারবে না। আইন লঙ্ঘনকারী ব্যক্তির ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন ২০০৯ অনুসারে বিচার হবে। বিচারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে অনূর্ধ্ব এক বছর বিনা শ্র ম কারাদণ্ড অথবা ন্যূনতম পাঁচ হাজার এবং অনূর্ধ্ব ২৫ হাজার টাকা আর্থিক দণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
দুই বছর আগেও একবার আমরা সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখেছিলাম জবাইখানাগুলোর ভয়াবহ চিত্র। এবার দেখা যায়, পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি, বরং আরো খারাপ হয়েছে।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট
সমপ্রতি মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে পশু জবাইখানাই গিয়ে দেখা যায়, লম্বা স্যাঁতসেঁতে ঘরে গোটা পঞ্চাশেক ছোট আকারের রুগ্ন গরুর পাশে বাঁধা চারটি মহিষ। তিনটি গরু মৃতের মতো সোজা হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। এক যুবক ও এক কিশোর ওই ঘরে ঢুকে একটি মহিষের সব পা বেঁধে ফেলে। এরপর মহিষটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে যুবক ছোট একটি ছুরি দিয়ে একাই জবাই করেন। কোনো দোয়া পড়তে শোনা গেল না। ছুরি চালানো হলো বেশ কিছু সময় ধরে। মহিষটির ধড় তখনো কাঁপছে। এরই মধ্যে চামড়া ছাড়ানো শুরু করেন জবাইকারী যুবক। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বালতি ও ছুরি হাতে ঢোকেন আরেক তরুণ। রোগা চেহারা, চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। মেঝেতে পড়ে থাকা একটি গরুকে ধরে দেখলেন তরুণটি। গরুর সাড়া নেই। এবার এক বালতি পানি ছিটিয়ে দিতেই নড়ে ওঠে গরুটির কান। এবার মৃতপ্রায় গরুটির মাথা টেনে ড্রেনের পাশে আনা হয়। এরপর এক পা দিয়ে গলার ওপর চেপে ধরে একটি ছোট ছুরি ১০ বার চালানো হয় গরুটির গলায়। এবারও কোনো দোয়া পড়তে দেখা বা শোনা গেল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গরুটির চামড়া ছাড়ানোর জন্য কয়েকটি ঘা দেওয়া হয়। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যে আরেকটি মৃতপ্রায় গরু একই কায়দায় জবাই করেন তরুণ কসাই।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট নতুন কাঁচাবাজার এলাকায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের পশু জবাই স্ল্যাবে (জবাইখানা) এভাবেই পশু জবাই শুরু হয়ে চলল সকাল পর্যন্ত। সকাল ৭টা পর্যন্ত দেখা মেলেনি সিটি করপোরেশনের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক, মোল্লা, সিলম্যান বা ক্লিনারের!
একের পর এক মৃতপ্রায় গরু জবাইকারী তরুণটির নাম আরশাদ। থাকেন জেনেভা ক্যাম্প এলাকায়। গরু জবাই করছেন সাত বছর ধরে। আরশাদ জানালেন, তিনি কৃষি মার্কেটের মাংস ব্যবসায়ী গুড্ডুর গরু জবাই করছিলেন। এক রাত কাজের মজুরি ৩০০ টাকা। জবাইয়ের উদ্দেশ্যে জড়ো করা গরু-মহিষগুলো মার্কেটের ব্যবসায়ী মুন্না, গুড্ডু, কাইউম, পারভেজ ও গোলাম মোস্তফার। আরশাদের দাবি, দুই দিন আগে আনার পর গরুগুলো ভালোই ছিল। শনিবার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জবাইখানায় হুজুর ও চিকিৎসক আছে কি না জানতে চাইলে আরশাদ বলেন, শুনছি আছে। দেখি নাই। দোয়া না পড়ে জবাইয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে আরশাদ বলেন, বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার বলছি তো। আর আমি তো দুইবার পোচ দিছি।
এভাবেই চলছে রাজধানীর সবগুলো জবাইখানায় পশু জবাইয়ের কাজ। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট স্যানিটারি অফিসার থাকলেও দেখে মনে হয় দেখার কেও নেই। যার যেমন খুশি সে সেভাবেই পশু জবাই করে বিক্রি করছেন। এমনও শোনা যায় সাগির উপর খাসির সিল মেরে ছেড়ে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। কসাইদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে নাকি এমনটি হয়ে থাকে বলে জানালেন নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন।
আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এবং স্বাস্থ্যসম্মত ও ধর্মীয় বিধান মতে যাতে মাংস জবাই ও বিক্রি হয় সেদিকে দৃষ্টি দেবেন।