দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ দেখতে দেখতে আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস পা রাখলো ৪৩ বছরে। ইতিহাসের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই মার্চ মাস এলেই সেই ১৯৭১ এর উত্তাল দিনগুলোর কথা আমাদের মনে পড়ে যায়। সেই অগ্নিঝরা মার্চ! আমাদের আজকের এই আয়োজন মহান স্বাধীনতা দিবসকে নিয়ে।
এই মার্চেই আমাদের বাঙালিদের জীবনে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণেই আজকের এই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার মাস আমরা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ থেকে শুরু করে খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে চুক্তি, ২১ মার্চে জিন্নাহর রেসকোর্সের দাম্ভিক ভাষণ, অপারেশন সার্চ লাইট, ২৫ মার্চের গণহত্যার পথ পেরিয়ে অবশেষে আসে আমাদের সেই ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলার মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে যে বিভীষিকাময় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল- দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে আমরা অবশেষে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছেছিলাম। ১৯৭০এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরেও পাকিস্তানী সেনারা নির্বিচারে আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ, বুদ্ধিজীবী, নারী-শিশু সহ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সামরিক অফিসারদের হত্যা করে। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হয় যে মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমাণ্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বার্তা দিচ্ছেন। আরো জানানো হয় যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করা হয়েছে যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর থাকবে। এ রাষ্ট্র সকল জাতির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয় এ বার্তায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এৰং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবার দাবিদার বলে দাবি করা হয় এ বার্তায়।
আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, একটি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পেয়েছি। এসব তথ্য কম বেশি আমাদের সকলেরই জানা অন্তত একজন বাঙালি হিসাবে আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদেরই।
মহান স্বাধীনতা দিবসের পথ ধরে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। আমরা অর্জন করি লাল-সবুজ পতাকা। যদিও আমাদের পতাকায় আগে লাল সূর্যের মাঝে হলুদে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র শোভা পেতো। অন্যান্য আন্তর্জাতিক দিবসের মতো আমাদের স্বাধীনতা দিবসও এখন পৃথিবীর বুকে একটি পরিচিতি পেয়েছে গুগলের কল্যাণে। গতবছর গুগল তার পেইজে আমাদের বাংলাদেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে একটি লোগো দিয়েছিলো। সে সুবাদে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ জেনেছিলো আমাদের স্বাধীনতার কথা ।
প্রবাসী বাঙালিরাও প্রতিনিয়ত দেশের বাইরে আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত করে চলেছেন।তবে প্রত্যেকটি অর্জনের পেছনেই থাকে একটি জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাস; প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির ।
তবে এ বছরের স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অন্যান্য বছরের চেয়ে ভিন্ন আমেজের। কারণ দেশের আপামর জন সাধারণকে দুর্ভোগে রেখে এবং দেশের অস্তিত্ব অস্বীকার এবং অপশক্তির সাথে হাত মিলিয়ে অনেক যুদ্ধাপরাধী বুক ফুলিয়ে স্বাধীন বাংলায় বসবাস করে আসছিলো। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণা শুরু হওয়ায় এবারের স্বাধীনতা দিবস জাতীয় জীবনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একাত্তরের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবীতে শাহবাগ আন্দোলন এবং নতুন প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণে বাংলাদেশ ন্যায্য প্রাপ্তির পথেই এগোচ্ছে।
অনেক নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধা বা সাধারণ মানুষ এ যুদ্ধে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের অনেকেই সঠিক পুনর্বাসনের অভাবে যথাযোগ্য বীরের মর্যাদা পান নি। যদিও প্রতি বছর এ দিবসকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক ধরণের কর্মসূচি হাতে নেয়া হয় কিন্তু প্রকৃত যারা যোদ্ধা কিংবা তাদের পরিবার তাদের প্রতি প্রকৃত সহযোগিতার আন্তরিক ইচ্ছা নিয়ে সরকার সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বা ব্যক্তি পর্যায়ে আমাদেরই এগিয়ে যাওয়া উচিত। ভুয়া মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটধারীদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
তবে এ বছরের স্বাধীনতা দিবস নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই এক ব্যাপক প্রস্তুতির কথা শোনা যাচ্ছে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে সকল স্তরের জনগণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণ এবং গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে বাংলাদেশের নাম সংযোজিত করা নিয়ে ২৬ মার্চ মঙ্গলবার, জাতীয় প্যারেড স্কোয়াডে সকাল ১১ টায় গাওয়া হবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। এখানে অংশ নেবে আনুমানিক ৩ লাখেরও অধিক মানুষ জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের প্রথম নারী স্পীকার মাননীয়া ডঃ শিরিন শারমীন চৌধুরী ।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের লেখা “ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ” এই গান লাখো কণ্ঠে গাওয়া হবে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক সহ আরো অন্যান্য খ্যাতনামা শিল্পীদের তত্ত্বাবধানে। বিস্তারিত জানতে দেখুন এখানে লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা
তবে আমাদের এটাও জানা উচিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু ভাষার জন্য হয়নি, স্বাধীনতার জন্য হয়েছে আর ভাষার জন্য সংগ্রাম ৫২ এর আগে থেকে শুরু। যে কারণে এমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ৩০ লক্ষ লোকের প্রাণহানি সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার চেতনা বা আমাদের স্বাধীনতার যে ইতিহাস সেটা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গল্পের মতো শোনালেও তা যে আদতে গল্প নয়, একটি জাতির অস্তিত্বের দলিল, একটি চেতনা তা স্বাভাবিক বিবেকসর্বস্ব মানুষ মাত্রই স্বীকার করবেন। স্বাধীনতা দিবস মানে এই না যে আমাদের মুখমণ্ডলে, হাতে রংতুলিতে বাংলাদেশের পতাকা আঁকবো, মাথায় লাল-সবুজ ব্যাজ ধারণ করবো, বিশেষ দিনগুলোতে শহীদদের স্মরণ করবো, শহীদমিনারে যাবো বা তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাকে উদযাপন করে নেবো। ২৬ মার্চ আমাদের চেতনায় ধারণ করবো, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে শিখবো, স্বাধীনতার গৌরবময় চেতনাকে আমাদের অন্তরে লালন করবো এবং দেশের সম্মান একে অন্যকে শ্রদ্ধার মাধ্যমে, সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে পতাকার সম্মান অক্ষুন্ন রাখবো – এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। কেননা স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে হলে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা আর এই সচেতনতাবোধ ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয়েরই আয়ত্ত্ব করতে হবে।