পাতা তালুকদার পূর্ণ নাম নিলুফার ইয়াসমিন, যমুনার চর শিবপুরের বাসিন্দা। আজ আমরা জানবো পাতা তালুকদারের জীবন যুদ্ধের কথা। সামনে থেকে একজন মানুষের সংগ্রামী জীবনের বৃত্তান্ত জানতে যেয়ে যেভাবে অনুভূতি বা আবেগ উপস্থিতি সে মুহূর্তে কাজ করেছিল সে সত্য আবেগের বিন্দুমাত্র হয়তো এ লেখায় তুলে ধরতে পারবনা।
পাতার বাবা মারা গেছেন যখন পাতা ক্লাস ফাইবে পড়তেন। পাতারা মোট পাঁচ ভাই-বোন। দুই মেয়ে তিন ছেলে সন্তান নিয়ে পাতার মা স্বামীর অবর্তমানে অভাব অনটনেই সংসার চালাচ্ছিলেন। তবে পাতার মা সেই সময় থেকেই সন্তানদের লেখা পড়া করাতে সচেষ্ট ছিলেন। তাই তিনি প্রতিবেশীদের বাড়ি-বাড়ি কাজ করতেন। এক দিকে পাঁচ ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ এবং সংসার খরচ অন্য দিকে পাতার বড় ভাই হঠাৎ পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ নেয়। এ সময় অভাব অনটনে পাতার মা বাধ্য হয়ে দুই মেয়েকে বিয়ে দেন। পাতার বিয়ের সময় তার বয়স মাত্র ১৪ বছর।
যদিও পাতার মা দুই মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তবে সেই সময় তিনি তার মেয়ে জামাইদের থেকে কথা নিয়েছিলেন যে তার মেয়েরা বিয়ের পর পড়ালেখা চালিয়ে যাবে। ফলে পাতা এবং তার বোন দুই জনই স্বামীর ঘরে থেকেই সংসারের পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যায়। পাতা এবং তার বোন প্রায় দেড় ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতেন প্রতিদিন। এভাবেই সংগ্রাম করে এক সময় পাতার বড় বোন এইচএসসি পাশ করে স্থানীয় গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরী নেন।
এখানেই পাতাদের জীবনের কঠিন সময় শেষ হলনা। বিধাতার হয়ত ভিন্ন রকম পরিকল্পনা ছিল। পাতার বোন একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দিয়ে পর দিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বগুড়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। একই ঘটনায় পাতার মা এবং বোনের শিশু সন্তান গুরুতর আহত হয়। এ সময় পাতা তালুকদারের জীবনে আসে আরেকটি নতুন অধ্যায়। পাতার কাঁধেই সমগ্র পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে। পাতা বাধ্য হয়েই এসএসসি পাশ করেই এলাকার বিভিন্ন শিশুদের গণিত এবং ইংরেজি পড়াতেন। বিভিন্ন ক্লাস ভেদে বিভিন্ন ফি দিয়ে ছেলে মেয়েরা পাতার কাছে শিক্ষা নেয়। যেমন ক্লাস ৪ এর শিক্ষার্থীরা ১০০ টাকা, ক্লাস ফাইভের শিক্ষার্থীরা ১৫০ এবং ৬,৭,৮ এর শিক্ষার্থীরা ৩০০ টাকা দিয়ে পাতার কাছে গণিত এবং ইংরেজি বিষয়ে প্রাইভেট পড়ত।
টিউশনি করিয়ে পাতা নিজের এবং দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ সহ পরিবারের সকল খরচ চালায়। এভাবেই পাতারা নিজেদের অভাবের কারণে শিক্ষা গ্রহণ বাদ না দিয়ে এগিয়ে যায় অদম্য আগ্রহে। পাতার দুই ভাই এর মাঝে যে কিনা পাতার থেকে বড় সে ইতোমধ্যে বিএসসি পাশ করেছেন। পাতার ছোট ভাই এইচএসসি পাশ করেছেন। পাতা বর্তমানে পলিটিক্যাল সাইন্স নিয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে পড়ছেন। এরই মাঝে পাতা জানতে পারেন তার এলাকায় NGO’তে ট্রেইনার পদে চাকরী জন্য আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে। পাতা সেখানেই আবেদন করেন এবং চাকরী পান, যদিও বেতন মাসিক মাত্র ১৫০০ টাকা তাও পাতা জানায় তিনি তার কাজ উপভোগ করছেন।
পাতা NGO এর পক্ষ থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষদের কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দিতে থাকে, এতে করে দুর্গম চরের সাধারণ কৃষকরা সঠিক জমিতে, সঠিক সময়ে, সঠিক ফসলের আবাদের বিষয়ে ধারণা লাভ করে। এই কাজকে পাতা সাধারণ মানুষের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় বলেই মনে করেন এবং পাতা নিজেকে এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত রাখার কারণে গর্ভবোধ করেন।
পাতার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একজন সরকারি চাকরিজীবী হওয়া। পাতার স্বপ্ন বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সরকারি চাকরী করে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করা। তবে পাতা জীবনে নানান উত্থান পতনে কখনো জীবন যুদ্ধে হার মানেনি। তিনি সব সময় নিজের মনোবল ঠিক রেখে প্রত্যয়ের সাথে এগিয়ে গেছেন।
পাঁচ বছর বয়সী পাতার কন্যা সন্তান হয়তো ভবিষ্যতে মায়ের জীবন যুদ্ধ এবং শত-প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে তার মা কিভাবে স্বপ্নের পথে হেঁটেছে তাই দেখে ভবিষ্যতের দিকে নিজেকেও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এটি কেবল বাংলাদেশের একজন পাতার জীবন কাহিনী। বাংলাদেশে এমন অসংখ্য পাতা তালুকদার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাংলাদেশের ইতিহাস সংগ্রামী ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষও জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করেই নিজেদের এগিয়ে নিচ্ছে বহুদূর। আর যারা পথ হারাচ্ছেন, বৈরী জীবন ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে তাদের পাতা তালুকদারের মতো কিছু মানুষ জুগিয়ে চলেছে সামনে যাওয়ার প্রেরণা। বিশ্বাস রাখতে হবে নিজের এবং ইচ্ছাশক্তির উপর, পরাজয় নয়, জয়ই সংগ্রামী মানুষের শেষ কথা।
ধন্যবাদ:রুবাইয়াত সারওয়ার