এম. এইচ. সোহেল ॥ হযরত শাহজালাল (রহ:) ও হযরত শাহপরান (রহ:)সহ ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি এবং প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত বৃহত্তর সিলেট। প্রকৃতির এই অপরূপ সৃষ্টির অন্যতম একটি হলো গোয়াইনঘাটের জাফলং ও তামাবিল এলাকা।
৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি এই সিলেটে গেলে প্রথমেই সবাই হযরত শাহজালাল (রহ:) ও হযরত শাহপরান (রহ:) এর মাঝার শরীফ জিয়ারত করে নেন। তারপর চলে যান সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানে। জাফলং এবং তামাবিল একটি আদর্শ বেড়ানোর স্থান।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপর নাম জাফলং
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পর্যটনের সেরা আকর্ষণ সিলেটের এই তামাবিল ও জাফলং এলাকা। ওপারে খাসিয়া জৈন্তারের বিশাল পাহাড় আর এপারে নদী। পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলছে ঝরনা আর নদীর বুকে স্তরে স্তরে সাজানো বিভিন্ন রঙের নুড়িপাথর। এতো পাথর আসছে কোথায় থেকে। স্বচোক্ষে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না। আর এ কারণেই বলা হয়ে থাকে ৩৬০ আউলিয়াল পুণ্যভূমি এটি। এই সিলেটে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস। আবার এখানকার জাফলং-এর পাথর দেখলে সেটিই মনে করিয়ে দেয় সকলকে। পাথর আর পাথর, এতো পাথর আসছে কোথায় থেকে?
দূর থেকে তাকালে মনে হবে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। বিশাল পাহাড়ের গায়ে নরম তুলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘরাশি। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য আর কোথায় পাওয়া যাবে জাফলং ছাড়া এখানেই শেষ নয়, সমতল চা বাগান, খাসিয়া পল্লী, পানের পুঞ্জি। কী নেই জাফলংয়ে! সিলেটের জাফলংকে তাই বলা হয়ে থাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রকৃতিকন্যা নামেও রয়েছে আলাদা পরিচিতি। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে ভারতের সীমান্তঘেঁষা দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের এ জনপদকে। জাফলংয়ের সৌন্দর্য দেখতে তাই প্রতি বছরই দেশ-বিদেশের প্রচুর পর্যটক ভিড় করেন এখানে। এখানে অনেকেই আসেন পিকনিক করতে। আবার পারিবারিকভাবেও অনেকেই আসেন এখানে। ঋতু বৈচিত্রের সাথে জাফলংও তার রূপ বদলায়। সৌন্দর্যে আসে বৈচিত্র। প্রতিদিন তাইতো হাজার হাজার পর্যটক আসছেন এখানে, এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্য। বর্ষায় গেলে এখানে দেখা যাবে ওপারের পাহাড় থেকে নেমে আসা অগণিত ঝরনা। সবুজের বুকে নেমে আসা ঝরনাধারায় সূর্যের আলোর ঝিলিক ও পাহাড়ে ভেসে বেড়ানো মেঘমালা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে পর্যটকদের। আবার শীতে অন্য রূপে হাজির হয় রূপের রানী হিসেবে খ্যাত জাফলং। চার দিকে তখন সবুজের সমারোহ, পাহাড় চূড়ায় গহিন অরণ্য। এতো বড় পাহাড় যেনো এখানে উঠতে দিন শেষ হয়ে যাবে। তাই শীত ও বর্ষা সব সময়েই বেড়ানোর উপযুক্ত স্থান হতে পারে জাফলং। জাফলংয়ের বুক চিরে বয়ে গেছে দুই নদী। ধলাই ও পিয়াইন। এই নদী দু’টি অনন্যতা এনে দিয়েছে জাফলংকে। ধলাই ও পিয়াইনের স্বচ্ছ পানিতে বাঁকে বাঁকে ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন জাতের ছোট মাছ। দুই নদীতে ডুব দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিকের পাথর উত্তোলনের দৃশ্যও মুগ্ধ করে পর্যটকদের। নদীর পানিতে নারী-পুরুষের এই ‘ডুবোখেলা’ দেখা যায় ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি। সীমান্তের ওপারে ডাউকি নদীর ওপরে দুই পাহাড়ের মাঝখানে ঝুলন্ত সেতু বাড়িয়ে তুলেছে জাফলংয়ের সৌন্দর্য। পাহাড়, পানি, পান, পাথর আর ঝরনা- সব মিলিয়ে জাফলং যেন এক রূপকথার রাজ্য। নাগরিক জঞ্জাল আর কোলাহল ছেড়ে দু’দণ্ড শান্তি খুঁজে নিতে তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এমনকি দেশের বাইরে থেকেও দল বেঁধে জাফলংয়ে বেড়াতে আসেন পর্যটকেরা। ভাড়া নৌকায় পিয়াইন ও ধলাইর বুকে ভেসে বেড়ানোর সুযোগও রয়েছে এখানে।
পাহাড় আর নদীতে সীমাবদ্ধ নয় জাফলংয়ের সৌন্দর্য। জাফলংয়ের সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে সেখানকার আদিবাসীদের জীবনধারা। নদী পার হলেই খাসিয়াপুঞ্জি। খাসিয়াদের গ্রামকে বলা হয় পুঞ্জি। এসব পুঞ্জিতে গেলে দেখা যাবে ৩-৪ ফুট উঁচুতে বিশেষভাবে তৈরি খাসিয়াদের ঘর। প্রতিটি বাড়িতে সৃজিত পানবরজ। মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়া সম্প্রদায়ের পুরুষেরা গাছ বেয়ে বরজ থেকে পান পাতা সংগ্রহ করেন। আর বাড়ির উঠোনে বসে নারীরা পানপাতা ভাঁজ করে খাঁচাভর্তি করেন বিক্রির জন্য। পানপাতা সংগ্রহ ও খাঁচাভর্তি করার অভিনব দৃশ্য পর্যটকদের নজরকাড়ে। পানবরজ ছাড়াও খাসিয়া পল্লীতে দেখা যাবে কমলা বাগান। কাঁচা-পাকা কমলায় নুয়ে আছে বাগানের গাছ। সংগ্রামপুঞ্জির রাস্তা ধরে আরেকটু এগোলে দেখা যাবে দেশের প্রথম সমতল চা বাগান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা রাজার অধীন নির্জন বনভূমি। ১৯৫৪ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর খাসিয়া জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটে। তার পরও কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পতিত পড়েছিল। ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করেন। পাথর ব্যবসায়ের প্রসার ঘটতে থাকায় গড়ে ওঠে নতুন জনবসতিও। এখানে গড়ে উঠেছে বহু পাথর ভাঙ্গা কারখানা। বড় বড় মেশিন দিয়ে ভাঙ্গা হচ্ছে পাথর এবং সেই পাথর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আশির দশকে সিলেটের সাথে জাফলংয়ের ৫৫ কিলোমিটার সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে জাফলংয়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পাশাপাশি প্রকৃৃতিপ্রেমীরাও ভিড় করতে থাকেন জাফলংয়ে। একসময় দেশের সেরা পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয় জাফলং।
আরেক সৌন্দর্যের প্রাণকেন্দ্র তামাবিল
আরেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে জাফলং এলাকা যেতে মাত্র ৬ কিলোমিটার আগের এই এলাকা তামাবিল। এখানেও রয়েছে অজস্র পাথর ভাঙ্গা কারখানা। এখানে রয়েছে সব আধুনিক পিকনিক কর্ণার। তামাবিলের এসব সৌন্দর্য মণ্ডিত এলাকাগুলো পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। এখানকার পিকনিক কর্ণারে রয়েছে প্রাকৃতিক সব সৌন্দর্য। প্রকৃতির এসব সৌন্দর্য আপনাকে যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। রয়েছে বেশ কয়েকটি পাহাড়। এসব পাহাড়ি আপনিও উঠতে পারবেন। এক মজার আনন্দ পাহাড়ে ওঠা। প্রতিটি পিকনিক স্পটে রয়েছে নানা রকমের বনরাজি। গাছ-গাছালি, হরিণসহ নানা রকমের পশু-পাখি দিয়ে সমারোহ ঘটানো হয়েছে পিকনিক কর্ণারগুলোতে। ভেতরে রয়েছে জলধারা, নৌকা নিয়ে বেড়ানোর সুযোগ। এসব জলরাশিতে জাতীয় ফুল ফুটে রয়েছে অজস্রধারায়। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য রেস্ট হাউসের ব্যবস্থা আছে। যে কেও এখানে এসে উঠতে পারেন। পার্কের ভেতরে দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে বিভিন্ন স্থানে। এখানে গিয়ে পর্যটকরা হারিয়ে যাবেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলায়। তাই শীত কিন্বা বর্ষা উভয় সময় সমানভাবে সৌন্দর্যের আচ্ছাদনে ঢেকে রয়েছে সিলেটের এই তামাবিল ও জাফলং।