আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ॥ দেশ কোন পথে? এই প্রশ্নটি এখন সবার মুখে মুখে। সঠিক জবাবটি সম্ভবত কারোই জানা নেই। আমারও জানা আছে, এ কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। তবে ভালো হোক আর মন্দ হোক, দেশে এই রাজনৈতিক পোলারাইজেশনটির (মেরুকরণের) দরকার ছিল। পঁচাত্তরের গ্রেট ন্যাশনাল ট্র্যাজেডির পরই এই রাজনৈতিক মেরুকরণের শুরু। একদিকে স্বাধীনতাযুদ্ধের সমর্থক পক্ষ, অন্যদিকে স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর মূলত স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু এই শত্রুপক্ষের চেহারা ও চরিত্র বোঝার উপায় ছিল না।
কারণ রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হলেও তার চেহারা এখনো স্পষ্ট নয়। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর সামরিক ও অসামরিক একদল ক্ষমতালোভী ব্যক্তি, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও অংশগ্রহণকারী ছিলেন, তাঁরা স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে ক্ষমতায় থাকার জন্য হাত মেলান; ক্ষমতায় তাদের অংশীদারও করা হয়। শুরু হয় উল্টোরথে বাংলাদেশের যাত্রা। ১৯৭১ সালের ঘাতক ও দালালদের গাড়িতে ওড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা। স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতাদের শুধু হত্যা করা নয়; স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল আদর্শেরও স্তম্ভগুলো একে একে ধ্বংস করার চেষ্টা শুরু হয়।
এই অবস্থায় সামরিক ছাউনিতে দু-এক জায়গায় জামায়াত মার খেয়েছে। তারা একাত্তরের গণহত্যার দাগ শরীর থেকে মুছতে পারেনি। ফলে বিএনপির রাজনৈতিক আশ্রয়ে নিজেদের হিংস্র নেকড়ের চেহারা লুকিয়ে নিরীহ মেষশাবকের মূর্তিতে বহু দিন দেশের রাজনীতিতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। মাঝেমধ্যে বাংলা ভাই বা এ জাতীয় জঙ্গি বা জঙ্গিপ্রতিষ্ঠানের সুবাদে জামায়াতের মুখোশ ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু অভিনব কৌশলে পবিত্র ইসলামের সোল এজেন্ট সেজে তারা সেই ছেঁড়া মুখোশ আবার জোড়া লাগাতে সক্ষম হয়েছে।
ফলে গত প্রায় ৪০ বছরেও দেশের রাজনীতির মেরুকরণ দুই ধারায় হতে থাকলেও তার চেহারাটা স্পষ্ট ধরা যাচ্ছিল না। যদি ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরো কিছুকাল আগে শুরু করা যেত, তাহলে এই মেরুকরণের চেহারা ও চরিত্র আরো আগে স্পষ্ট হতো। এখন যে সন্ত্রাস দেশময় শুরু করা হয়েছে, তা আরো আগে শুরু হতো। জামায়াত পাকিস্তান ও সৌদি বাদশাহদের মদদে আগে থেকেই অস্ত্র ও অর্থবলে সজ্জিত হয়ে প্রস্তুত হয়েই ছিল। আশা করছিল, বাংলাদেশের বিভক্ত ও দুর্বল গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলারিস্ট দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সাহসী ও সক্ষম হবে না।
ফলে মেষশাবকের মুখোশ উন্মোচন তাদের দরকার হবে না এবং আমেরিকার কাছ থেকে ‘মডারেট ডেমোক্রেটিক মুসলিম পার্টির’ সার্টিফিকেট নিয়ে তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রথমে বিএনপির কাঁধে ভর করে আধিপত্য বিস্তার করবে; তারপর সুযোগ ও সময়মতো বিএনপিকে লাথি মেরে সরিয়ে দিয়ে নিজেরাই ক্ষমতায় একাধিপত্য কায়েম করবে। তাদেরই ভাষায়- বাংলা হবে আফগান।
এক-এগারোর আবির্ভাব এবং গত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের নিরঙ্কুশ বিজয়লাভ জামায়াতিদের সব রাজনৈতিক হিসাব ব্যর্থ করে দেয়। আওয়ামী লীগ এখন পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-দানের ব্যাপারে দেশবাসীর কাছে ওয়াদাবদ্ধ, এ কথা জেনে প্রচুর অর্থব্যয়ে জামায়াত দেশ-বিদেশে এই বিচারপ্রচেষ্টা বানচাল করার জন্য প্রচারযুদ্ধ শুরু করে। সেই সঙ্গে এই হুমকিও দিতে থাকে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করা হলে তারা দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু করবে।
শেখ হাসিনা কোনো হুমকির কাছে মাথা নত করার মানুষ নন, এটা বহু আগেই প্রমাণ করেছেন। তথাপি দেশি-বিদেশি নানা ধরনের বাধা সৃষ্টির মুখে এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে এগিয়ে যেতে তাঁর সরকারকে হয়তো হোঁচট খেতে হতো।
কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঢাকার শাহবাগে বিশাল গণসমাবেশ ও তরুণ প্রজন্মের উত্থান আওয়ামী লীগ সরকার ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে শুধু বিচারপ্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে সাহসী করেনি, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো প্রভাব ও প্রতাপশালী যুদ্ধাপরাধীকে প্রাণদ-াদেশ দিতেও শক্তি জুগিয়েছে। জামায়াত তাদের বিরুদ্ধে এই গণ-অভ্যুত্থানটা হিসাবে আনেনি। তারা জানে, তাদের পেছনে গণসমর্থন নেই। তবু তরুণ জনতা মাঠে না নামলে তারা তাদের এত দিনের প্রস্তুতি অনুযায়ী ট্রেনিংপ্রাপ্ত ক্যাডার ও ভাড়াটিয়া লোক দিয়ে নকশালি কায়দায় হামলা চালিয়ে দেশময় অরাজকতা সৃষ্টি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-দান বানচাল করতে পারবে ভেবেছিল।
কিন্তু প্রজন্ম চত্বরের গণ-অভ্যুত্থান তাদের আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছে। ফলে ডেসপারেট জামায়াত মরিয়া হয়ে দেশে নকশালি-সন্ত্রাস সৃষ্টি দ্বারা সরকারকে মরণ কামড় দিতে সক্রিয়। তারা জানে, সন্ত্রাস সৃষ্টি দ্বারা তারা জয়ী হবে না। তাদের উদ্দেশ্য, সন্ত্রাস চালিয়ে দেশের মানুষকে ভীতিগ্রস্ত করে সরকার ও জনগণকে বিচ্ছিন্ন করা; তারপর সর্বশক্তি দ্বারা সরকারকে চূড়ান্ত আঘাত হানা। ট্রাইব্যুনাল ও বিচার বানচাল করে দেওয়া।
প্রথমে চোরাগোপ্তা হামলা, গাড়ি-বাস পোড়ানো দিয়ে শুরু। তারপর বগুড়া, রাজশাহী, কক্সবাজার, সিলেট ইত্যাদি; যেসব জায়গায় মাদ্রাসা ছাত্রদের মধ্যে তাদের ঘাঁটি রয়েছে, সেসব জায়গায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে অর্ধ শতাধিক লোকের তারা মৃত্যু ঘটিয়েছে। মৃতদের মধ্যে পুলিশও রয়েছে। কিন্তু যেখানে নকশালিরা ভারতে বাংলাদেশের জামায়াতিদের চেয়েও ভয়াবহ সন্ত্রাস চালিয়ে জয়ী হয়নি, সেখানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জনপ্রতিরোধের মুখে জামায়াতি-সন্ত্রাস সফল বা জয়ী হবে কিভাবে?
বিএনপির শীর্ষ নেতারা হয়তো ভেবেছিলেন, জামায়াতিরা এত দীর্ঘকাল ধরে নাশকতামূলক কাজে দলের ক্যাডারদের ট্রেনিং দিয়েছে, তাদের প্রাত্যহিক হামলার মুখে বর্তমান সরকার পিছু হটতে বাধ্য হবে। এ জন্য জামায়াতি-সন্ত্রাসে প্রত্যক্ষ সমর্থন না জানিয়ে তাঁরা এই সন্ত্রাসের সাফল্যের আশায় অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের কৌশল ছিল জামায়াতকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিতে গিয়ে তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন দানের দায়ে জড়াবেন না; দূরে ভালো মানুষ সেজে থাকবেন এবং পরোক্ষ সমর্থন জোগাবেন। তারপর জামায়াত দেশময় অরাজকতা সৃষ্টিতে সফল হলে তাঁরা সেই সাফল্যের ভাগীদার হতে ছুটে আসবেন। আবার বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনক্ষমতায় বসবে এবং এবার এটা হবে পুরোপুরি না হোক, হাফ তালেবানি শাসন।
কিন্তু বিএনপির হিসাব-নিকাশেও বড় ভুল ছিল। তারা বুঝতে পারেনি, ১৯৯৬ সালের আওয়ামী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা এবং বর্তমান আওয়ামী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা একই ব্যক্তি নন। বহু ঘা খেয়ে, বহু চক্রান্তের মোকাবিলা করে শেখ হাসিনা বদলে গেছেন এবং শক্ত হয়েছেন। অনেক বেশি অভিজ্ঞ হয়েছেন। তাই ভারতে নকশাল ও মাওবাদী সন্ত্রাস দমনে ইন্দিরা গান্ধী যে কঠোর ও শক্ত মনোভাব নিয়ে এগিয়েছিলেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্ত ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতা দমনে শেখ হাসিনা এবার তদ্রূপ কঠোরতা নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এবার তাঁর পাশে আছে বিশাল গণজোয়ার। তিনি ভয় পাবেন কেন?
শেখ হাসিনা ভয় পাননি। ফলে ক্যাডারভিত্তিক পকেটসন্ত্রাসে জামায়াত কোথাও কোথাও ভয়াবহ তাণ্ডব সৃষ্টি করতে পারলেও কোথাও অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারছে না। একবার পুলিশের হাতে ফুল গুঁজে দিয়ে, আরেকবার পুলিশ হত্যা করে- কোনো কৌশলেই তারা এগোতে পারছে না। ১০ বছর সন্ত্রাস চালিয়ে নকশাল আন্দোলন সফল হয়নি; জামায়াত ১০ মাসও এই তাণ্ডব অব্যাহত রাখতে পারবে কি না সন্দেহ। তাদের বিরুদ্ধে দেশময় যে বিশাল গণরোষ, তা এখনো শান্ত ও অহিংস। যদি জামায়াতিদের অতি বাড়াবাড়িতে এই গণরোষ গর্জে ওঠে, তাহলে জামায়াতিদের অস্তিত্বই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হবে।
সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার নামে গিয়ে খালেদা জিয়া কাদের সঙ্গে কী পরামর্শ করেছেন, কী উপদেশ নিয়ে এসেছেন জানি না। ঢাকার মাটিতে পা দিয়েই তিনি অভিনেত্রীসুলভ চমৎকার অভিনয় করেছেন। তাঁকে সংবর্ধনার জন্য আনা ফুলের মালা দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেছেন, ‘দেশে গণহত্যা চলছে। এ সময় কি ফুলের মালার সংবর্ধনা তাঁর নেওয়া সাজে?’ অতঃপর জামায়াতের ডাকা দুই দিনের (রবি ও সোমবার) হরতালের সঙ্গে আরো একটি দিন যোগ করে তিনি আজ মঙ্গলবারও হরতাল ডেকেছেন।
আমার ধারণা, যদি ভুল না হয়, তিনি সিঙ্গাপুরে বসেই লন্ডন থেকে পাঠানো পুত্র তারেকের মেসেজ পেয়েছেন যে জামায়াত বাংলাদেশে যত বড় সন্ত্রাস ঘটাক, তারা সফল হবে না। সরকারের সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম আছে, সুতরাং জামায়াতি-সন্ত্রাস দমনে সরকার সফল হবে। জামায়াতি তথা একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের চূড়ান্ত পরাজয় ঠেকানোর জন্য বিএনপির এই মুহূর্তে জামায়াতের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। সম্ভবত সিঙ্গাপুরে বসে তিনি ঢাকা থেকেও ‘মে ডে’ মেসেজ পেয়েছেন, জামায়াতি হিংস্রতা দমনে সরকার কঠোর; সুতরাং জামায়াতকে রক্ষায় বিএনপির ডাইরেক্ট সাহায্য ও অ্যাকশন দরকার। খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর থেকে ছুটে এসেই বিপন্ন মিত্রকে রক্ষার জন্য পাশে দাঁড়িয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির শক্ত ঘাঁটি বগুড়ায় ঘটেছে রবিবারের প্রথম দিনের হরতালে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মৃত্যু। এই মৃত্যুর জন্য সর্বাংশে দায়ী জামায়াতি-সন্ত্রাস ও তার সঙ্গে বিএনপির সহযোগিতা।
এই ঘটনার ফলে দেশে যে রাজনৈতিক মেরুকরণটি দীর্ঘকাল অস্পষ্ট ছিল, তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। এই পোলারাইজেশনের একদিকে এখন দেশের স্বাধীনতার পক্ষের গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার শিবির, অন্যদিকে স্বাধীনতার শত্রুপক্ষের শিবির। বিএনপি এখন শেষোক্ত এই শিবিরে সরাসরি যোগ দিল। এত দিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে তাদের যে একটি মুখোশ ছিল, জোড়াতালি দিয়ে যে মুখোশটি এত দিন রক্ষা করা গেছে, সেটি সম্পূর্ণ ছিঁড়ে গেছে এবং বিএনপি ও জামায়াতের এখন অভিন্ন চরিত্র। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী কোনো নেতা বা কর্মী যদি এখনো বিএনপিতে থেকে থাকেন, তাহলে তাঁদেরও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, তাঁরা কোন শিবিরে অবস্থান করবেন?
খালেদা জিয়ার আরেকটি সিদ্ধান্তের ফলে নির্ভুলভাবে ধরা পড়ল, বিএনপি ও জামায়াত এখন দুটি ভিন্ন নাম বটে; কিন্তু তাদের একই অভিন্ন চরিত্র ও লক্ষ্য। মাত্র দুদিন আগে বেগম সাহেবা দিল্লি সফরে গিয়ে ভারত সরকারকে অঙ্গীকার জানিয়ে এসেছেন যে তাঁর দল আর ভারতবিরোধিতার নীতি অনুসরণ করবে না। আর দুদিন না যেতেই তিনি জামায়াতি-হরতালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এমন একটি দিনে হরতাল ডেকেছেন, যেদিনটি ভারতের রাষ্ট্রপতির ঢাকা সফর শেষে দিলিস্নতে ফিরে যাওয়ার দিন।
এটা কূটনৈতিক শিষ্টতা, শালীনতা ও সৌজন্য; কোনো বিদেশি সরকারি মেহমান এলে কোনো দেশে বিরোধী দল হরতাল-আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখে। যদি তাদের বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ বিদেশি মেহমানের বিরুদ্ধেই হয়, সেটা অন্য কথা। যেমন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোনো দেশে সফরে গেলে জর্জ বুশকে কালো পতাকা দেখানো, জুতা নিক্ষেপের মতো ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে জামায়াতি-বিক্ষোভ, তা ভারত কিংবা ভারতের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে নয় বলা হয়েছে; এই বিক্ষোভ আওয়ামী লীগ সরকার এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে। এ সময় ভারতের রাষ্ট্রপতির মাত্র তিন দিনের বাংলাদেশ সফরের সময় কূটনৈতিক নিয়মরীতি রক্ষার জন্যই জামায়াত ও বিএনপির এই তিন দিনের হরতাল কিছুটা পিছিয়ে কি নেওয়া যেত না? অতীতে বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের সফরকালে হরতাল-আন্দোলন স্থগিত রাখার নজির আছে। তাহলে সেই নজির এবার ভাঙা হলো কেন?
জামায়াত এই কূটনৈতিক শালীনতা বিসর্জন দিয়েছে, তাতে আমি বিস্মিত হইনি। জামায়াত চরিত্রে একটি ভারতবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক দল। তার চরিত্র সন্ত্রাসীর। গণতান্ত্রিক চরিত্র তার নেই। কিন্তু বিএনপি গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত একটি বড় রাজনৈতিক দল ও সংসদীয় বিরোধী দল হিসেবে দেশে সফরে আসা বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের সম্মান জানানোর ব্যাপারে তার দায়বদ্ধতা আছে। এবার দেখা যাচ্ছে, জামায়াতের আলিঙ্গনে সম্পূর্ণ ধরা দিয়ে বিএনপি সেই দায়বদ্ধতাও অস্বীকার করছে। দেশের রাজনীতির বর্তমান মেরুকরণের চেহারাটি বোঝা ও জানা এখন কারো পক্ষে কিছুমাত্র কষ্টের কাজ কি?
লক্ষ করার বিষয়, এই হরতালের একটি বড় লক্ষ্য যে ভারতের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফর বানচাল করা এবং তাঁকে অবমাননার চেষ্টা করা; তা হরতালের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা থেকেই বোঝা যায়। তিনি বাংলাদেশে থাকছেন তিন দিন- রবি, সোম ও মঙ্গলবার। জামায়াত হরতাল ডেকেছে প্রথম দুই দিন। ভারতের রাষ্ট্রপতির স্বদেশযাত্রার দিন হলো মঙ্গলবার। জামায়াতি হরতাল তো এই দিনে নেই। সুতরাং তড়িঘড়ি মঙ্গলবারেই বিএনপি হরতাল ডেকে জামায়াতের অসমাপ্ত কাজে সমাপ্তি টানল বলে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারণা।
তাহলে দুই মিত্র দলের এই হরতাল ডাকার একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল কি ভারত-বিদ্বেষ প্রকাশ অথবা ভারতের রাষ্ট্রপতিকে অবমাননা করার চেষ্টা? একটি কূটনৈতিক শিষ্টতা ও রীতি হলো, দেশে বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক এলে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এই রীতি অনুযায়ী ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের সময় ছিল গতকাল সোমবার বিকেলে। খালেদা জিয়া আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি হরতালের দিন নিরাপত্তাজনিত কারণে ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসতে পারবেন না।
আগে জানা গিয়েছিল, তিনি জামায়াতের ডাকা হরতালের দিন হরতাল ভেঙে ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসবেন। এখন সে সিদ্ধান্ত পাল্টে যাওয়ায় অনেকেই মনে করেন, একদিকে মিত্র জামায়াতকে খুশি রাখা এবং অন্যদিকে ভারতকে অবজ্ঞা দেখানোর জন্য কাজটি তিনি করেছেন। সম্প্রতি ভারত সফরকালে দিলিস্নর কাছে তাঁর নতজানু হওয়ায় যে দুর্নামটি ঘটেছিল, সেই দুর্নামটি তিনি হয়তো দ্রম্নত ঘোচাতে চাইছেন।
বিএনপির শীর্ষমহলসংশিস্নষ্ট সূত্র থেকে জেনেছি, ভারতের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফর ব্যর্থ করার জন্য জামায়াত তিন দিনব্যাপী হরতাল দিতে না পারায় তৃতীয় দিনটি (মঙ্গলবার) কভার করার জন্যই বিএনপিনেত্রী সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়েই এই হরতালটি ডেকেছেন। যদিও তিনি জানেন, এই হরতাল সফল হবে না। ভয়তাল হবে। তবে জামায়াতিদের সন্ত্রাসে সাহায্য জোগানো হবে।
খালেদা জিয়ার এই কৌশলটি এতই নগ্ন যে তা বুঝতে ভারতের দেরি হয়নি। খালেদা জিয়া ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নিরাপত্তাজনিতে কারণ দর্শিয়ে সাক্ষাৎ করতে না চাওয়ায় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এতে ভারতকে অসম্মান করা হয়েছে। এই অবস্থায় বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জামায়াতের লাভ হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে বিএনপিকে সম্পূর্ণ অঙ্গাঙ্গি করে নিতে পেরেছে। এখন বিলেতের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ও লিবারেল পার্টি মার্জ করে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি নাম ধারণের মতো বিএনপি ও জামায়াত এক হয়ে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী জামায়াত’ নাম ধারণ করলে মন্দ হয় না।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশে জামায়াত-বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যতই রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালাক অথবা বাড়াক, দেশের রাজনৈতিক পোলারাইজেশন অথবা মেরুকরণটি তাতে এত দিনে স্পষ্ট হয়েছে। জনগণ এখন বুঝতে শুরু করেছে, স্বাধীনতার সপক্ষের ও বিপক্ষের শিবির কোন দুটি? এই উপলব্ধি থেকেই শাহবাগের গণ-অভ্যুত্থান এবং দেশময় তার বিস্তৃতি। তবে দম ফুরানোর আগ পর্যন্ত জামায়াত ও বিএনপির সন্ত্রাস চলবে, হয়তো আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। এ রকম তো ঘটেছে ব্রিটেনে আইআরএ এবং ভারতে নকশাল সন্ত্রাসের সময়। কিন্তু সফল হয়নি। নকশাল-সন্ত্রাস তো ভারতে ১০ বছর স্থায়ী হয়েছিল।
বাংলাদেশে জামায়াত ১০ বছর কেন, ১০ মাসও সন্ত্রাস জিইয়ে রাখতে পারবে, তা বিদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও মনে করেন না। কারণ এই সন্ত্রাস এখন আর একটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়, দেশের গোটা জনগণের বিরুদ্ধে। গণশত্রুরা কখনো জনগণের সঙ্গে চূড়ান্ত সংগ্রামে জয়ী হয়েছে- ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। (বাংলাদেশ নিউজ২৪ডট কমের সৌজন্যে)।