দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ১৭ই এপ্রিল ২০১২ থেকে ২০১৩, কেটে গেছে একটি বছর। কত দীর্ঘ হবে এ নির্মম অপেক্ষা কখন বাড়ি ফিরে আসবেন ইলিয়াস আলী। কোলে তুলে নেবেন ছোট্ট মেয়ে সাইয়ারা নাওয়ালকে। আবরার ও লাবিবকে জড়িয়ে ধরবেন বুকে। মা সূর্যবান বানু ও স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর দীর্ঘশ্বাসের অবসান হবে। ফিরবেন নাকি ফিরবেন না। তিনি জীবিত না মৃত- তা-ও জানে না কেও। আর কত অপেক্ষা?
মানুষ দুনিয়াতে বিদায় নেন এটি মহান সৃষ্টিকর্তার এক অঘোম নিয়ম। কিন্তু মাঝে মধ্যেই সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে। মানুষ দ্বারা এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার কোন কুল-কিনারা পাওয়া যায় না। এক বছর ধরে নিখোঁজ ইলিয়াস আলীকে নিয়ে এখনও আশাবাদী তার পরিবার। প্রধানমন্ত্রীর কথায় ভরসা করেই আশায় বুক বেঁধে আছেন তার পরিবার। ভরসা রেখেছেন আল্লাহর ওপর। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে অশীতিপর সূর্যবান ছেলে ইলিয়াসকে একবার দেখতে চান। রাজনৈতিক সহকর্মীসহ সিলেটবাসীর প্রশ্ন- মুক্ত ইলিয়াস আলী কি আবারও ছুটে বেড়াবেন ৩৬০ আউলিয়ার দেশ সিলেটের পথে-প্রান্তরে নাকি অপেক্ষাই চিরস্থায়ী হবে! ফিরবে না আর। অনিশ্চিত অপেক্ষায় কেটে যাবে স্বজন হারানো একটি পরিবারের দিন। ক্ষমতার পালাবদলে হারিয়ে যাবে সহযোদ্ধাদের স্মৃতি। সিলেটবাসীর হতাশা বয়ে নেবে সুরমার জল।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল। রাত তখন সাড়ে ১১টা। দীর্ঘদিনের আড্ডাস্থল হোটেল রূপসী বাংলা থেকে ফিরছিলেন বনানীর সিলেট হাউজে। যে বাড়িতে উঠেছিলেন তার মাসখানেক আগে। সে বাড়ির ২০০ মিটার দূরে মহাখালীর আমতলী ক্রসিং পেরিয়ে বনানীর দিকে টার্ন নিয়েছিল তার গাড়িটি। নানা সূত্রে এ পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ইলিয়াসকে তুলে নেয়ার সময় সামনে-পেছনে ছিল দু’টি দল। হঠাৎ পেছন থেকে একটি গাড়ি তার গাড়িতে আঘাত করে। উদ্দেশ্য ইলিয়াসকে রাগান্বিত করে গাড়ি থেকে বের করা। কিন্তু ইলিয়াস আলী বের হননি। বেরিয়েছিলেন চালক আনসার। মারধর করে দু’টি গাড়িতে তুলে তাদের নেয়া হয় অজানার উদ্দেশে। পরিত্যক্ত অবস্থায় তার গাড়িটি পড়ে থাকে সেখানে। ঘটনার অন্তত দুই ঘণ্টা পর রাত দেড়টায় পুলিশ ফোন করে পরিত্যক্ত গাড়ির কথা জানায় ইলিয়াসের পরিবারকে। ঘটনা পরম্পরায় পরিষ্কার, সবকিছুই হয়েছে নিখুঁত পরিকল্পনামাফিক। প্রত্যক্ষদর্শীরা নানা সময়ে গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ইলিয়াস আলীকে যখন তুলে নেয়া হয় তখন তাদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন কাছেই ডিউটিরত এক পুলিশ কর্মকর্তা। চিৎকার চেঁচামেচি শুনেছিল পাশের নির্মাণাধীন ভবনের প্রহরীরা। নিজের চোখে দেখেছেন মোড়ের ডাব বিক্রেতা। ঘটনার বিহ্বলতা কাটিয়ে পরদিন গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলার চেষ্টা করেছিলেন তাদের কেও কেও। কিন্তু তারপর থেকে তাদের আর কোন খোঁজ নেই।
প্রথম কয়েক দিন গুমের বিষয়টিকে পাত্তাই দেয়নি সরকার। মন্ত্রীদের কেও বলেছেন, খালেদা জিয়ার পরামর্শে আত্মগোপনে গেছে ইলিয়াস। কেও বলেছেন, দলের লোকজনই তাকে অপহরণ করেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীই বলেন, ইস্যু তৈরির জন্য নাটক সাজানো হচ্ছে। এ নিয়ে গাদা গাদা বিশ্লেষণ লিখেছেন সরকার সমর্থক কলামনিস্টরা। কথার থুবটি ফুটিয়েছেন টিভির টকশোতে। গুমের চার দিনের মাথায় র্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে গাজীপুরের পুবাইল এলাকায় একটি নিষ্ফল অভিযান চালায়। অভিযানে সঙ্গে নেয়া হয় ইলিয়াসের স্ত্রীকেও। এ অভিযান ছাড়া আর কোন অভিযান দৃশ্যমান হয়নি। জানা গেছে, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, রাজবাড়িতেও অভিযান চালানো হয়েছে। সিলেটের ভারতীয় সীমান্তবর্তী কিছু চা-বাগানে তৎপরতা ছিল বেশ কিছুদিন। তল্লাশির নামে হানা দেয়া হয় তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের বাগানবাড়িতে। কাওকে কাওকে ভয়-ভীতিও দেখানো হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক সমাবেশে বলেছিলেন, ১২০০ অভিযান চালানো হয়েছে। তিনি ‘জীবিত উদ্ধারই লক্ষ্য’ এবং ‘শিগগিরই ফিরে আসবে’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন। এক পর্যায়ে বন্ধ করে দেয়া হয় উদ্ধার তৎপরতা। সার্বিকভাবে ইলিয়াসের ঘটনায় সরকারের আচরণ পুরোটাই নির্লিপ্ত অভিযোগ করা হয়েছে সব সময়। ক্ষেত্রবিশেষে রহস্যজনকও বটে। অন্যায় করলে উদ্ধারের পর বিচারের উদ্যোগ নিতে পারতো সরকার। কিন্তু উদ্ধার তৎপরতার চেয়ে সরকারের তরফে বেশি হয়েছে অপপ্রচার। একজন প্রতিমন্ত্রী তো ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে বিধবা বলেও মন্তব্য করেছেন। ইলিয়াসের সন্ধান চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তার পরিবার। প্রধানমন্ত্রী সান্ত্বনা দিয়েছেন তার স্ত্রী তাহসীনা রুশদিরকে। মাথায় হাত বুলিয়েছেন তার সন্তানদের। উদ্ধারে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঈদের উপহার হিসেবে বাবাকে ফেরত চেয়েছিল তার ছোট্ট মেয়ে নাওয়াল। কিন্তু সে সান্ত্বনার কার্যকারিতা কিছুই দেখেনি দেশবাসী।
ইলিয়াসের বৃদ্ধ মা শোকে পাথর হয়ে গেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি একবার ইলিয়াস আলীকে দেখতে চান। মায়ের সেই আকুতি মহান সৃষ্টিকর্তা কি শুনবেন? ইলিয়াস আলী কি আর কোন দিন ফিরে আসবেন? এমন প্রশ্নই এখন শুধু সবার মনে।