দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ কাল বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ২০১৫ সালের ২৯ মার্চ হতে যাচ্ছে একাদশ আসর। এর আগের ১৯৭৫-২০১১ বিশ্বকাপের ১০ ফাইনালে কি ঘটিছিল তা জেনে নেওয়া যাক।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের একাদশ আসর শেষ হতে চলেছে। রাত পোহালেই শিরোপা লড়াই শুরু হবে। শিরোপা লড়াইয়ে মুখোমুখি হচ্ছে এবারের আসরের দুই সহ-আয়োজক অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ জিল্যান্ড। মেলবোর্নের সকালের ফাইনালের আগে গত ১০ আসরের ফাইনালগুলোতে আসলে কি ঘটেছিল জেনে নেওয়া যাক।
লর্ডস, লন্ডন ২১ জুন, ১৯৭৫ প্রথম ফাইনাল:
প্রথম ফাইনালে অংশ নেই অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই আসরে অস্ট্রেলিয়াকে ১৭ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রথম আসরের শিরোপা জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
এই আসরে ম্যাচ সেরা ক্লাইভ লয়েডের অসাধারণ শতকে ৬০ ওভারে ৮ উইকেটে ২৯১ রান তোলে ক্যারিবিয়ানরা। ডেনিস লিলি, জেফ টমসনদের মতো পেসারদের বিপক্ষে ৮৫ বলে ১০২ রানের চমৎকার ইনিংস সেদিন উপহার দেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক। আর জবাবে কিথ বয়েসদের (৪/৫০) দারুণ বোলিংয়ে অলআউট হয়ে ২৭৪ রানে গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া।
লর্ডস, লন্ডন ২৩ জুন, ১৯৭৯ দ্বিতীয় ফাইনাল:
এবারও ওয়েস্ট ইন্ডি শিরোপা অক্ষুন্ন রাখে। সেবার স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে ৯২ রানে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
‘কিং’ রিচার্ডস ইনিংসের শেষ বলে হেঁটে গিয়ে অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলকে ফ্লিক করে যে ছক্কা মারেন, সেটি হয়ে আছে ক্রিকেট ইতিহাসে রূপকথার এক চিরন্তন অংশ। রিচার্ডস (অপরাজিত ১৩৮) এবং কলিন্স কিংয়ের (৮৬) দারুণ ব্যাটিংয়ে ৬০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৮৬ রান করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
অপরদিকে জবাব দিতে গিয়ে ইংল্যান্ড উদ্বোধনী জুটিতে তুলে ফেলে ১২৯ রান। ৩৯তম ওভারে সেই জুটি ভাঙার পর এক সময়ে দুই উইকেট ১৮৩ রানেও পৌঁছেছিল তারা। সেখান হতে রানের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে মাত্র ১১ রানে যায় শেষ ৮টি উইকেট।
লর্ডস, লন্ডন ২৫ জুন, ১৯৮৩ তৃতীয় ফাইনাল:
এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৪৩ রানে হারিয়ে অঘটনের বিশ্বকাপে শিরোপা জিতে নেয় ভারত। অ্যান্ডি রবার্টস, গার্নার, ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিংয়ের পেস ব্যাটারির সামনে মাত্র ১৮৩ রানে অলআউট হয়ে যায় ভারত।
তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের টানা তৃতীয় শিরোপা জয় যখন সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিল, ঠিক তখনই ভারতের অধিনায়ক কপিল দেব দিলেন সেই অমর এক ক্রিকেটীয় বাণী, ‘ছেলেরা, আমাদের স্কোর যদি ম্যাচ জেতার মতো না-ও হয়, তবে লড়াই করার মতো তো বটেই। এসো আমরা আজ সেই লড়াইটাই করি।’
সামনে থেকেই সেই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন কপিল দেব। মিড উইকেটে প্রায় ২০ গজ পেছন দিকে দৌড়ে বিপজ্জনক রিচার্ডসের দারুণ এক ক্যাচ তালুবন্দি করেন তিনি নিজেই। আর তাতেই যায় ম্যাচের মোড় ঘুরে।
সেইদিন মদনলাল-মহিন্দার অমরনাথদের মতো মিডিয়াম পেস বোলারদের সামনেও আত্মাহুতির মিছিলে সামিল হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কালজয়ী ব্যাটিং লাইন; মাত্র ১৪০ রানে অলআউট হয়ে যায় তারা। ব্যাটিংয়ে ২৬ রান করা অমরনাথ বোলিংয়ে ৭ ওভারে ১২ রান দিয়ে নেন তিন উইকেট। এভাবেই সেদিন জয় এসেছিল।
ইডেন গার্ডেনস, কোলকাতা ৮ নভেম্বর, ১৯৮৭ চতুর্থ ফাইনাল:
এবার কোলকাতাতেও ভারত কোনো সুবিধা করতে পারেনি। রোমাঞ্চকর ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডকে ৭ রানে হারিয়ে শিরোপার প্রথমটি জেতে অস্ট্রেলিয়া।
প্রথমে ব্যাট করে ৫ উইকেটে ২৫৩ রান তোলে অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচ সেরা ডেভিড বুনের ৭৫ রান যে ইনিংসের মূল ভিত্তি ছিল। শেষ দিকে মাইক ভেলেটার ৩১ বলে অপরাজিত ৪৫ রানে আড়াইশ’ পার করে তারা।
জবাবে বিল অ্যাথি (৫৮) আর মাইক গ্যাটিং (৪১) ইংল্যান্ডকে জয়ের পথেই নিয়ে যাচ্ছিলেন। মাত্র ২ উইকেটে ১৩৫ রান সংগ্রহ করে তারা। কিন্তু হঠাৎ অ্যালান বোর্ডারকে অহেতুক রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ক্যাচ দেন গ্যাটিং। আর ঠিক সেই মুহূর্তটি বিবেচিত আগের আসরের ফাইনালে কপিলের নেওয়া রিচার্ডসের ক্যাচের মতোই হয়ে দাড়ায়। খেলা মোড় নেই টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে। গ্যাটিংয়ের আউটে ধাক্কা খাওয়া ইংল্যান্ডের ইনিংস শেষ পর্যন্ত থেমে যায় ৮ উইকেটে ২৪৬ রানে।
এমসিজি, মেলবোর্ন ২৫ মার্চ, ১৯৯২ পঞ্চম ফাইনাল:
তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে খেলা ইংল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে নেয় পাকিস্তান।
২৪ রানের দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে শুরুটা যদিও ভালো হয়নি পাকিস্তানের। এরপর দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ইমরান খান (৭২) এবং জাভেদ মিয়াঁদাদ (৫৮) তাদের ইনিংসকে স্থিতি দেন। শেষ দিকে ইনজামাম উল হক (৩৫ বলে ৪২ করেন) ও ওয়াসিম আকরামের (১৮ বলে ৩৩ রান) ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ৬ উইকেটে ২৪৯ রানে ইনিংস শেষ করে পাকিস্তান।
জবাবে ইংল্যান্ডের শুরুটাও ছিল একেবারে এলোমেলো। স্কোরবোর্ডে ৬৯ রান তুলতেই ৪ উইকেট হারিয়ে বসে তারা। অ্যালান ল্যাম্ব ও নেইল ফেয়ারব্রাদারের ৭১ রানের জুটি তাদের কক্ষপথে ফেরালেও শেষরক্ষা হয়নি তাদের। ম্যাচ সেরা আকরামের দারুণ বোলিংয়ে শেষ পর্যন্ত ২২৭ রানে অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড।
গাদ্দফি স্টেডিয়াম, লাহোর ১৭ মার্চ, ১৯৯৬ ষষ্ঠ ফাইনাল:
এই আসরে অস্ট্রেলিয়াকে ৭ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা। এই প্রথম কোনো দল বিশ্বকাপের ফাইনালে লক্ষ্যকে তাড়া করে কাপ জিতে নেয়।
প্রথমে ব্যাট করে ৭ উইকেটে অস্ট্রেলিয়া ২৪১ রান তোলে। ওই ইনিংসের মুল শক্তি ছিল অধিনায়ক মার্ক টেলরের ৭৪ রান।
লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ২৩ রানের মধ্যে সনাৎ জয়সুরিয়া, রুমেশ কালুভিথারানাকে হারায় শ্রীলঙ্কা। অশঙ্কা গুরুসিংহকে নিয়ে তারপর ১২৫ রানের জুটি গড়ে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেন ডি সিলভা। এরপর অধিনায়ক রানাতুঙ্গার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন ৯৭ রানের জুটিতে শ্রীলঙ্কাকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতান তিনি। অধিনায়ক যখন জয়সূচক রান নেন, ঠিক তখন ডি সিলভা অপরাজিত ১০৭ রানে।
লর্ডস, লন্ডন ২০ জুন, ১৯৯৯ সপ্তম ফাইনাল:
এই আসরে সাবেক চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে টানা তিন শিরোপার প্রথমটি জয় করে অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপের সফলতম এই দলটির এটি ছিল দ্বিতীয় শিরোপা।
ওই আসরে ৩৯.১ ওভার ব্যাটিং করে মাত্র ১৩২ রানে গুটিয়ে যায় পাকিস্তান। তাদের ইনিংসের সর্বোচ্চ ছিল মাত্র ২২ রান। সেটি এসেছিল ইজাজ আহমেদের ব্যাট হতে।
অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ ট্র্ফিরস্পর্শ নিশ্চিত করে মোটে ২০.১ ওভার ব্যাটিং করে মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে। ঝড়ো অর্ধশতক করে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (৩৬ বলে ৫৪ রান)। সেমি-ফাইনালের মতো ফাইনালেও ৪ উইকেট নেন শেন ওয়ার্ন। দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন বিশ্বখ্যাত এই লেগ স্পিন জাদুকর শেন ওয়ার্ন।
নিউ ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়াম, জোহানেসবার্গ ২৩ মার্চ, ২০০৩ অষ্টম ফাইনাল:
ভারতকে ১২৫ রানে হারিয়ে টানা তিন শিরোপার দ্বিতীয়টি জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপে ৩টি শিরোপা জেতে তারা।
টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং বিস্ফোরক শতকে এক অর্থে এক অর্ধেই খেলা শেষ করে দেন। অসাধারণ ইনিংস খেলে দুই উইকেটে ৩৫৯ রানের পাহাড় গড়ে অস্ট্রেলিয়া।
এই বিশাল রানের পাহাড় টপকানোর সাধ্য ভারতের ছিল না। প্রথম ওভারেই শচিন টেন্ডুলকার আউট হয়ে যাওয়ায় সেটি হয়ে পড়ে আরও অসম্ভব। বিরেন্দর শেবাগ (৮২) অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন। তবু জয়ের ধারেকাছেও যেতে পারেনি ভারত। ৩৯.১ ওভারে মাত্র ২৩৪ রানে অলআউট হয়ে তারা।
কেনসিংটন ওভাল, ব্রিজটাউন ২৮ এপ্রিল, ২০০৭ নবম ফাইনাল:
এই আসরে শ্রীলঙ্কাকে ডাকওয়ার্থ ও লুইস পদ্ধতিতে ৫৩ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপে টানা তৃতীয় এবং সব মিলিয়ে চতুর্থ শিরোপা জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া।
ওয়ানডের সেরা টুর্নামেন্টে এই প্রথম কোনো ফাইনাল হলো ‘রি-ম্যাচ’। শ্রীলঙ্কার সামনে অবশ্য সুযোগ ছিল ১৯৯৬ সালের পুনরাবৃত্তি করার। কিন্তু সেটি ছাপিয়ে প্রতিশোধই হয়ে গেলো অস্ট্রেলিয়ার।
সেবার বৃষ্টির কারণে ৩৮ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে ৪ উইকেটে ২৮১ রান করে অস্ট্রেলিয়া। এতে সবচেয়ে বড় অবদান ১০৪ বলে গিলক্রিস্টের ১৪৯ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলা।
দ্বিতীয় উইকেটে জয়াসুরিয়া এবং কুমার সাঙ্গাকারা ১১৬ রানের জুটিতে ভালোই করছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই দুজনের বিদায়ের পর আর উঠে দাড়াতে পারেনি শ্রীলঙ্কা।
আবার মাঝখানে বৃষ্টি নামলে শ্রীলঙ্কাকে ৩৬ ওভারে করতে হবে ২৬৯ রান। তার ধারে কাছেও যেতে না পারায় শ্রীলঙ্কার ইনিংস থেমে যায় ৮ উইকেটে ২১৫ রানে।
ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম, মুম্বাই ২ এপ্রিল, ২০১১ দশম ফাইনাল:
এই আসরে টানা দ্বিতীয় ফাইনালে খেলা শ্রীলঙ্কাকে ৬ উইকেটে হারিয়ে বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় শিরোপা জয় করে ভারত।
প্রথমে ব্যাট করে মাহেলা জয়াবর্ধনের (১০৩) অপরাজিত শতকে ৬ উইকেটে ২৭৪ রান তোলে শ্রীলঙ্কা।
এরপর লাসিথ মালিঙ্গা, টেন্ডুলকার, শেবাগকে দ্রুত ফিরিয়ে দিলে ম্যাচের পাল্লা কিছুটা হলেও হেলে যায় লঙ্কানদের দিকে। কিন্তু গৌতম গম্ভির, বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনিরা ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনেন ভারতের দিকে। লং অনের উপর দিয়ে ছক্কা মেরে ধোনি ভারতের ৬ উইকেটের জয় নিশ্চিত করে।
এভাবে শেষ হয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ১০টি ফাইনাল। একাদশ ফাইনালে ভোরে মুখোমুখি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। এখন সময়ই বলে দেবে কে নেবে এই শিরোপা।