মে দিবস বা পহেলা মে হলো বিশ্বব্যাপী মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে রক্তবিসর্জন দেওয়া এক মহান আত্মোৎসর্গের দিন। মে দিবস হচ্ছে সকল শ্রমিকের সংগ্রাম,অধিকার, সকল অমানবিকতা, শোষণ ও শোষকের প্রতি মালিক পক্ষের এবং রাষ্ট্রের নগ্ন সমর্থনের বিপরীতে একটি মানবিক কর্মক্ষেত্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার এবং শ্রমজীবী মানুষের মানুষ হিসেবে বাঁচার স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রামের প্রতীক।
মে দিবসের পটভূমি
বিখ্যাত মনীষী ড্যাশিং এর মতে,”মানুষ তখন-ই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যখন সে তার ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যুগে যুগে শ্রমিক সমাজ ও মেহনতি জনতা তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবী ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কখনও আপোষ করেনি। মূলত শ্রমিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৮০৬ সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার জুতা তৈরীর কারখানা হতে। সেখানে শ্রমিকদের উপর অমানবিক আচরণ, অকথ্য নির্যাতন, উপুর্যপুরি হয়রানি, গ্রেফতার হুলিয়া জারী ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।অবশেষে একটি শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে ; আত্মপ্রকাশ পায় ‘আমেরিকান ফেডারেল অব লেবার’।
এরপরের ঘটনা সেই উনিশ শতকের শেষ দিকে যে সময় শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে শিল্প মালিকদের অনীহা প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করে। অনেকটা দাসপ্রথার অনুকরণে শ্রমিকদের সপ্তাহে ছয়দিন ১০-১৬ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করা হত। বিনিময়ে মিলত সামান্য মজুরি। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে একদল শ্রমিক দৈনিক আট ঘন্টা কাজসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। দাবি জানায় — ‘আট ঘন্টার বেশী কাজ নয় – সপ্তাহে একদিন ছুটি চাই।’অতিরিক্ত শ্রম বিনিয়োগ করে স্বাস্থ্যহানী অথবা অকালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন আর নয়। এই দাবি পূরণের জন্য তারা সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত।
১৮৮৬ সালের ১ মে আন্দোলনের জন্য শ্রমিকরা সমবেত হয়, ডাকে ধর্মঘট। শান্তিপূর্ন শ্রমিক ধর্মঘটের মিছিলে পুলিশ নিরীহ শ্রমিকদের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। ঘটনাস্থলেই পুলিশের গুলিতে জুতা শ্রমিক থাই,পার্সন সহ চার জন শ্রমিকের বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। গুলি বর্ষণ ও হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ১৮৮৬ সালের ৪ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কোয়ারে বৈশাখের তপ্ত কাঠফাটা রৌদ্রে আমেরিকার ১১ হাজার জুতার কারখানা হতে লাখ লাখ শ্রমিক শাণিত হয়। সমবেত হয় ৬ লক্ষাধিক শ্রমিক। সমবেত শ্রমিক সমাজ বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তোলে — ‘আট ঘন্টা কাজ চাই, আট ঘন্টা ঘুম চাই, আট ঘন্টা বিশ্রাম চাই’।
তাদের অদূরেই বিপুল সংখ্যক পুলিশ সতর্ক অবস্থান নেয়। কিন্তু এসময় হঠাৎ একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। যাতে একজন পুলিশ সদস্য মারা যান। এতেই মারমুখি হয়ে ওঠে পুলিশ। শ্রমিক-পুলিশ দাঙ্গা বেঁধে যায়। ১১ জন শ্রমিক মারা যায় সেদিন। কিন্তু বোমাটি কারা ফাটিয়েছিল সে রহস্যের কোন কিনারা হয়নি আজ পর্যন্ত। উসকানী দেবার জন্য শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে কেউ এটি করে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করেন অনেকে।
রাজপথে অবস্থান রত একজন শ্রমিক একটি সাদা কাপড় তার সঙ্গী ভাইয়ের রক্তে লাল করে ফেলে এবং রক্তাক্ত কাপড়টি উড়িয়ে দেয় আকাশে। সেই রক্তাক্ত কাপড় আজও শ্রমিকের লাল পতাকার স্মারক স্মৃতি হিসাবে বহন করছে। যাই হোক, শ্রমিক হত্যার বিষয়টি তখন থেকেই অবহেলিত রয়ে যায়, কিন্তু চলতে থাকে দূর্বার আন্দোলন। মালিক পক্ষ দিশেহারা হয়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের মধ্য থেকে ৮ জন শ্রমিক নেতা – (১) আলবার্ট পাসনার্স (২) অগাষ্টাস স্পাইজেজ (৩) এডলফ ফিসার (৪) জর্জ এঞ্জেল (৫) লুইস লিংগে (৬) স্যামুয়েল ফিলডেন (৭) মাইকেল স্কোয়ার (৮) অস্কার নীবে – কে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করায় পুলিশ হত্যার অভিযোগে। একটি প্রহসনমূলক বিচারের পর প্রকাশ্যে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসির মঞ্চ আরোহনের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, “আপনারা যদি মনে করেন যে আমাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে লক্ষ কোটি নিপীড়িত ও বঞ্চিত শ্রমিকদের ন্যায় সঙ্গত সংগ্রাম বন্ধ করা যাবে, তাহলে দিন আমাদের ফাঁসি। কিন্তু এখানেই আপনারা একটা স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করবেন। দেখবেন, এখানে-সেখানে আপনাদের সামনে-পিছনে সর্বত্র আন্দোলনের অগ্নিশিখা জ্বলে উঠবে; এ এক এমন অনিবার্ণ অগ্নিশিখা যা নেভানোর শক্তি আপনাদের নেই।”
ফাঁসির মঞ্চে দাড়িয়ে আলবাট পাসনর্স শ্রমিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “অনেক সূর্য অস্ত যাবে কিন্তু পাসনর্সদের নাম শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস থেকে মুছে যাবে না। চিরদিন অমর অক্ষয় হয়ে থাকবে বিশ্বের শ্রমিক জনতার হৃদয়ে।”
পরর্তীতে ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন ইলিনয়ের গভর্নর স্বীকার করে নেন যে অভিযুক্ত আটজনই নিরপরাধ ছিলেন। আর শ্রমিকদের ওপর হামলার নির্দেশ প্রদানকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের ২য় আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে ১ মে-কে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসে হিসেবে পালেনর সিদ্ধান্ত হয়। তবে একই বছর বেঁকে বসে যুক্তরাষ্ট্র। তারা ধরে নেয় প্রতি বছর শ্রমিক হত্যার দিনটিকে স্মরণ করাটা পুঁজিবাদের জন্য সুবিধাজনক নয়। সেপ্টেম্বরের ১ম সোমবার-কে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। কিন্তু, ১৮৯০ সাল থেকে ১ মে থেকেই মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন শুরু হয়। অবশেষে আইএলও দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবীকে স্বীকৃতি দেয় এবং মে দিবস আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
অন্যদিকে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সোভিয়েত রাশিয়ায় মে দিবস অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপিত হতে থাকে। মস্কোয় সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ ট্যাঙ্ক, রকেট সাজোয়াযান প্রভৃতি নিয়ে কুচকাওয়াজে অংশ নিতেন। সোভিয়েত ব্লকের পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে মে দিবস উদযাপনের মাত্রাটা স্বাভাবিকভাবেই বেশি ছিল। ১৯৯৯ সাল থেকে বিশ্বায়ন বিরোধীরা মে দিবসকে তাদের বিশ্বায়ন বিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শনের একটি দিন হিসেবে বেছে নেয়।
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশঃ
দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে শ্রমিকদের নির্যাতন আর বঞ্চনার কথা। এ রাষ্ট্রে শ্রমিকদের গার্মেন্টস এর ভিতরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দেয় মেইন গেইট, অবর্ণনীয় কষ্টকর পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে রেখে শ্রমিকদের খাটানো হয়, নিয়োগপত্রহীন-মনুষ্যোচিত বাঁচার মতো মজুরী ব্যতীত ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করতে বাধ্য করা হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ১,৫০০ শ্রমিক মারা গেছে, ২৫০ এর বেশি ঘটেছে দুর্ঘটনা যার মধ্যে ৮০টি বড়। হত্যালীলা চলছে বিগত ৪২ বছর ধরে। শ্রমিক মরছে আগুনে পুড়ে বা পদদলিত হয়ে বা বিল্ডিং ভেঙ্গে -– একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। কিন্তু কেন? কারণ এই সব ঘটনার পেছনে যারা আছেন, তাদের কোন বিচার নেই। আইনের শাসন তো থাকতে হবে। ২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ভবন ধ্বসে প্রায় ৮০ জন মারা যায়। ভবন ধ্বসের ঘটনায় হাইকোর্টের জারি করা রুলের জবাব দীর্ঘ আট বছরে দেয়নি সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা। ওই ঘটনায় সরকারের তদন্ত রিপোর্টও আদালতে দাখিল করা হয়নি। ২০১২ সালে তাজরিন ফ্যাশনস লিমিটেড নামের ওই কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ২০০ এর বেশি শ্রমিক, আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অনেককে। কিন্তু কারো বিচার হয়েছে কি তাজরিন ফ্যাশন লিমিটেড এর মালিক পক্ষীয়দের? ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের জীবন এবং ভাগ্যও রয়ে গেছে দূর্ঘটনার মতই বিশ্রী এবং শোচনীয় অবস্থাতেই। গত এপ্রিল মাসে ঘটে গেলো সাভার ট্রাজেডী, লাশ হলো প্রায় পাঁচশ নিরীহ শ্রমিক, আহত হাজারের মত! এই অবর্ণনীয় ক্ষয়-ক্ষতির কি কোন পূরণ সম্ভব হবে? কখনই সম্ভব নয়। যারা শারীরিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই বরণ করে নিয়েছেন মানসিক ভারসাম্যহীনতাকেও।
রাষ্ট্রীয় শাসক এবং মালিকদের শোষণের ইতিহাস এখনও বদলায়নি এই বাংলাদেশে। মে দিবসকে ঘোষণ করা হয়েছিলো রক্তাক্ত অগ্নি শপথের দিন হিসাবে – বলা হয় এই দিবসই শ্রমজীবি মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের এক রক্তাক্ত ফসল। কিন্তু সে ফসল আবাদ কি ভোগ করতে পারছে বাংলাদেশের শ্রমজীবি মানুষজন? এই প্রশ্নের পরেও প্রশ্ন থাকে ১ মে দিবসের বিপ্লব এবং চেতনা কি ডুকরে কেঁদে ওঠে না আমাদের দেশের দুর্ঘটনায় কবলিত হতাভাগা শ্রমিকদের লাশ এবং রক্তের মধ্যে?