দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আমরা তেলাপোকা মারার ওষুধ দিলেই দেখতে পায় অনেক তেলাপোকা চিৎ হয়ে আছে। দুএকটি জীবিত থাকলেও দেখা যায় চিৎ হয়ে আছে। একবার চিৎ হলে সেটি আর বাঁচে না। সেটি উঠেও দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু কেনো এমনটি হয়?
একটি কথা প্রবাদ বাক্যের মতো প্রচলিত রয়েছে। আর তা হলো, পারমাণবিক যুদ্ধে যদি পৃথিবী ধ্বংসও হয়ে যায়, পৃথিবীর সব প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত যে অল্প কিছু প্রাণী বেঁচে থাকবে, তাদের মধ্যে তেলাপোকা নাকি অন্যতম। এর অর্থ অবশ্য এই নয়, তেলাপোকা অমর। বরং এই ধারণা এসেছে এই কারণে, তেলাপোকা অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে থাকে। এরা পানি ছাড়া প্রায় এক সপ্তাহ ও কোনো খাবার ছাড়াই প্রায় এক মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। শুধু তাই নয়, কোনো আঘাতে তেলাপোকার মাথা তাদের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও তারা খুব দ্রুত কাটা জায়গার ছিদ্র বন্ধ করে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে দিব্যি বেঁচে থাকে!
তারপরেও নির্দিষ্ট জীবনসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর, শত্রুর আক্রমণে কিংবা কীটনাশক প্রয়োগে নিয়মিতই তেলাপোকা মৃত্যুবরণ করে থাকে। বেশির ভাগ মানুষের বাসাবাড়িতে মৃত্যুবরণ করে, তাদের অধিকাংশই পিঠ নিচের দিকে দিয়ে উল্টো হয়ে মারা যেতে দেখা যায়। প্রশ্ন আসতে পারে কেনো তেলাপোকা চিৎ হয়ে মৃত্যুবরণ করে? বিজ্ঞানী ও গবেষকরা বিভিন্ন সময় এর বিভিন্ন ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
তেলাপোকা চিৎ হয়ে মৃত্যুবরণ করার একটি বড় কারণ হলো মৃত্যুর সময় এর শারীরিক সক্ষমতা হ্রাস পায়। স্বাভাবিক অবস্থায় উল্টে গেলেও এরা এদের লম্বা পাগুলো ব্যবহার করে সহজেই আবার নিজেদেরকে সোজা করে ফেলে। তবে জীবনের শেষ দিকে
বা কোনো কীটনাশকের কারণে যদি এরা উল্টে যায়, তখন আবার সোজা হওয়ার জন্য পেশীতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন, তার যোগান দিতে না পারায় এরা আর সোজা হতে পারে না। তখন ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
লম্বা লম্বা ৬ পা বিশিষ্ট তেলাপোকাকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য পায়ের পেশী শক্তিকে কাজে লাগাতে হয়। শরীরে যথেষ্ট পুষ্টি থাকতে হয় পায়ের পেশীতে নিয়মিত রক্ত সরবরাহ করার জন্য। বৃদ্ধকালে অথবা অসুস্থ অবস্থায় এদের পক্ষে তাই পায়ের উপর শরীরের ভর রেখে দাঁড়িয়ে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। সে সময় এদের পাগুলো দুর্বল হয়ে বাঁকা ও ভাঁজ হয়ে আসে। এরকম অবস্থায় যদি কোনোভাবে এদের শরীর উল্টে যায়, তাহলে পাগুলোকে স্বাভাবিক ভাঁজ হয়ে থাকা অবস্থা হতে সোজা করে তার উপর ভর দিয়ে সোজা হওয়া এদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
আরেকটি কারণ হলো, তেলাপোকার পাগুলো লম্বা হওয়ার কারণে এদের দেহের ভারকেন্দ্র বেশ উঁচুতে বিদ্যমান। শক্তিশালী অবস্থায় অবশ্য এতে এদের চলাফেরায় কোনো রকম সমস্যা হয় না। তবে মৃত্যুকালীন শারীরিক দুর্বলতার কারণে এদের পক্ষে লম্বা পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের পা ভাঁজ হয়ে আসে ও মাটিতে বসে পড়ার পর তাদের পিঠের বক্রাকার, মসৃণ গঠনের কারণে বেশির ভাগ সময়ই তারা নড়াচড়া করতে গিয়ে চিৎ হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় ৫ হাজার প্রজাতির তেলাপোকা রয়েছে। তবে এদের অধিকাংশই বনে-জঙ্গলে বসবাস করে। এদের মধ্য মাত্র আধ ডজন থেহতে দশ প্রকার তেলাপোকা আবাসিক এলাকায় বসবাস করে বা উপযোগী বলা যায়।
তারপরেও প্রায় সময়ই অনেক ভিন্ন প্রজাতির তেলাপোকা ভুল করে মানুষের বাসা-বাড়িতে ঢুকে পড়ে। একবার ঢুকে পড়লে এরা সেখান থেকে আর সহজে বের হওয়ার কোনো পথ খুঁজে পায় না। এই ধরনের তেলাপোকা বনে-জঙ্গলে বসবাসে অভ্যস্ত বলে মনুষ্য নির্মিত মসৃণ টাইলসের মেঝে এদের চলাচলের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। মসৃণ তলের উপর চলাফেরা করতে এদের সমস্যা হয়, কোনোভাবে যদি একবার উল্টে যায়, তাহলে সোজা হয়ে দাঁড়ানো এদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই শুধু বৃদ্ধ বা অসুস্থ তেলাপোকাই নয়, বরং সুস্থ-সবল তেলাপোকাও একবার চিৎ হয়ে গেলে যদি কেও তাকে সাহায্য না করে, তবে ধীরে ধীরে সেটি মৃত্যুবরণ করবে।
তবে এ ক্ষেত্রে তেলাপোকা বেশ বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে থাকে। একবার চিৎ হয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও যখন সোজা হতে পারে না তখন তারা মৃতের ভান করে পড়ে থাকে। তখন যদি কোনো শত্রু প্রাণী তাদেরকে স্পর্শ করে, অথবা মানুষ যদি ঝাড়ু বা অন্য কিছু দিয়ে তাদেরকে সরানোর চেষ্টা করে, সঙ্গে সঙ্গে এটি সেই প্রাণী অথবা ঝাড়ুকে আঁকড়ে ধরে সোজা হয়ে উঠে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে।
অপরদিকে কীটনাশকের প্রভাবে যা ঘটে তা হলো, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তেলাপোকার ৬টি পা বিশেষভাবে ভাঁজ হয়ে থাকতে হয়। এটি শুধুমাত্র পুষ্টি ও রক্তপ্রবাহের উপরেই নির্ভর করে না, বরং প্রতিজোড়া পায়ের মধ্যে বিস্তৃত একগুচ্ছ স্নায়ুতন্ত্রের উপরও অনেকটা নির্ভর করে। এগুলো প্রতিনিয়ত উদ্দীপনা প্রদানের মাধ্যমে পাগুলোর নড়াচড়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। তেলাপোকা যে মাথা ছাড়াও চলাফেরা করতে পারে, এটিই তার অন্যতম একটি কারণ।
আমরা সাধারণ মারার জন্য তেলাপোকার উপর যেসকল কীটনাশক প্রয়োগ করি, তার অধিকাংশই নিউরোটক্সিন। অর্থাৎ এগুলো সরাসরি তেলাপোকার স্নায়ুতে বিষক্রিয়া ঘটায় ও এদের স্নায়ুবিক কার্যক্রমকে প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত করে। এই বিষাক্ত কীটনাশকগুলো তেলাপোকার শরীর হতে কোলিনেস্টেরেস নামক একপ্রকার এনজাইম তথা উৎসেচক নি:সরণে বাধা প্রদান করে থাকে। এই উৎসেচকগুলোর কাজ হচ্ছে অ্যাসিটাইলকোলিন (ACh) নামক এক রকম জৈব যৌগকে বিভাজিত করা, যা স্নায়বিক কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
এক্ষেত্রে কীটনাশকের কারণে কোলিনেস্টেরেসের নি:সরণ কমে যাওয়ার কারণে তেলাপোকার স্নায়ুতন্ত্রে অতিরিক্ত ACh আসতে থাকে। যে কারণে এদের শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এদের পায়ের পেশীগুলো সংকোচিত হতে শুরু করে ও মাঝে মাঝে একেবারে অসাড় হয়ে যায়। যে কারণে এরা পুরোপুরি পায়ের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। যেহেতু এদের শরীরের ভারকেন্দ্র বেশ উপরে, তাই পায়ের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এরা বেশির ভাগ সময় চিৎ হয়ে পড়ে যায়। তখন আর উঠতে না পেরে ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করে।
যদি সব তেলাপোকাই যে চিৎ হয়ে মৃত্যুবরণ করে এমনটি নয়। বরং বিজ্ঞানীদের মতে চিৎ হয়ে মৃত্যুবরণ করাটা তেলাপোকার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নয়, এটি বরং ব্যতিক্রম। প্রকৃতিতে বনে-জঙ্গলে যে বিপুল সংখ্যক তেলাপোকা বসবাস করে থাকে, তাদের ক্ষুদ্র একটি অংশই কেবল এভাবে মৃত্যুবরণ করে বলে গবেষকরা মনে করেন।