ভুল থেকে যেভাবে আবিষ্কার হয়েছিলো চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ যুগে যুগে মানুষ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুক্ষিন হয়েছে এবং আবিষ্কার করেছে তার সমাধান। পেনিসিলিন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এমনই একটি অসামান্য আবিষ্কার। ব্যাকটেরিয়া ঘটিত বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায় তা নিয়ে কাজ শুরু করেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং।

অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর একটি ভুলের মাধ্যমে তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন পেনিসিলিন নামে একটি প্রতিষেধক। এটি পৃথিবীতে আবিষ্কৃত প্রথম এ্যান্টিবায়োটিক যা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, যিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং জীবাণুতত্ত্ববিদ।

১৯২১ সালের ঘটনা, তখন ইংল্যান্ডের সেন্ট মেরিজ মেডিকেল স্কুলের ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। কয়েকদিন ধরে তিনি ঠাণ্ডায় ভুগছিলেন। জীবাণু কালচার নিয়ে ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় হঠাৎ তীব্র হাঁচি এলো। ফ্লেমিং নিজেকে সামলাতে পারলেন না, জীবাণু রাখা সেটটা সরানোর আগেই হাঁচির দমকে নাক থেকে কিছুটা সর্দি সেটের জীবাণুর উপর পড়ে গেলো!

Related Post

পুরো জিনিসটা নষ্ট হয়ে গেল দেখে সেটটা সরিয়ে রেখে নতুন আরেকটা সেট নিয়ে কাজ শুরু করলেন। পরদিন ল্যাবরেটরিতে ঢুকে সরিয়ে রাখা সেই সেটটার দিকে নজর পড়তেই তিনি ভাবলেন সেটটা ধুয়ে আবার কাজ করবেন। কিন্তু সেটটি হাতে তুলেই চমকে উঠলেন ফ্লেমিং। অবাক ব্যাপার, গতকালের জীবাণুগুলো আর নেই! তার দেহ থেকে বের হওয়া সেই প্রতিষেধকটি জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেছে। তিনি দেহ থেকে বের হওয়া এই প্রতিষেধকটির নাম দিলেন লাইসো।

এরপর ১৯২৮ সালে ফ্লেমিং স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করছিলেন লন্ডনের এক ল্যাবরেটরিতে।এ গবেষণা কাজ চলাকালে তিনি দু’সপ্তাহের গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে যান স্কটল্যান্ডে। যাবার সময় তিনি স্টেফাইলোকক্কাসটি রেখে যান একটি কাঁচের পাত্রে এবং ভুল করে সেই গবেষণাগারের জানালা খুলে রেখে যান। যদিও এটি একটি ভুল ছিল তবুও এই ভুলের কারণেই ফ্লেমিং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্ময়কর জিনিসটি আবিষ্কার করেন।

দু’সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে গবেষণাগারে ফিরে তিনি আবিষ্কার করেন, কোন ফাঁকে ঝড়ো বাতাসের দমকে খোলা জানালা দিয়ে ল্যাবরেটরির বাগান থেকে কিছু ঘাস পাতা উড়ে এসে পড়েছে জীবাণু ভর্তি প্লেটের উপর। তিনি প্লেটগুলোতে দেখলেন জীবাণুর কালচারের মধ্যে স্পষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। ফ্লেমিং বুঝলেন এই আগাছাগুলোর মধ্যে এমন কিছু আছে যার জন্য পরিবর্তন ঘটেছে, পরীক্ষা করে দেখা গেলো আগাছাগুলোর উপর একরকম ছত্রাক জন্ম নিয়েছে। সেই ছত্রাকগুলো বেছে বেছে জীবাণুর উপর দিতেই জীবাণুগুলো ধ্বংস হয়ে গেল! তিনি বুঝতে পারলেন, তার এতোদিনের গবেষণা অবশেষে সার্থক হয়েছে! ছত্রাকগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম ছিল পেনিসিলিয়াম নোটেটাম, তাই তিনি এর নাম দিলেন পেনিসিলিন।

ফ্লেমিং ১৯২৮ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার করলেও এটি রোগ প্রতিরোধে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, বা এটা কতটা কার্যকরী অথবা জীবের দেহে এর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটে নাকি তা সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। রসায়ন সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকার কারণে পেনিসিলিন আবিষ্কার করলেও কীভাবে তাকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ঔষধ হিসেবে প্রস্তুত করা যায় তার কোন ধারণা ফ্লেমিং করে উঠতে পারেননি।

পেনিসিলিনকে মানবদেহে ব্যবহারের উপযোগী অবস্থানে নিয়ে আসেন দু’জন বিজ্ঞানী- হাওয়ার্ড ওয়াল্টার ফ্লোরি ও আর্নস্ট বোরিস চেইন।

১৯৩৮ সালে তারা পেনিসিলিন নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা শুরু করেন। ১৯৪০ সালে, প্রথমে তারা কিছু জীব জন্তুর উপর পরীক্ষা করে আশাতীত ভালো ফল পেলেন। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল মানুষের উপর পরীক্ষা। আকস্মিকভাবে সে সুযোগও এসে গেল। একজন পুলিশ কর্মচারী মুখে সামান্য আঘাত পেয়েছিলেন। তাতে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল তা দূষিত হয়ে জীবাণু রক্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। ডাক্তাররা তার জীবনের সব আশা ত্যাগ করেছিল। ১৯৪১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী প্রফেসর ফ্লোরি স্থির করলেন এই মুত্যু পথযাত্রী মানুষটির উপরই পরীক্ষা করবেন পেনিসিলিন। তাকে তিন ঘন্টা অন্তর চার বার পেনিসিলিন দেয়া হল। ২৪ ঘন্টা পর দেখা গেল যার আরোগ্য লাভের কোন আশাই ছিল না, সে প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে। এই ঘটনায় সকলেই উপলব্ধি করতে পারলো চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কী যুগান্তকারী প্রভাব বিস্তার করতে চলেছে পেনিসিলিন। ডা: চেইন বিশেষ পদ্ধতিতে পেনিসিলনকে পাউডারে পরিণত করলেন এবং ডাঃ ফ্লোরি তা বিভিন্ন রোগীর উপর প্রয়োগ করলেন। এরপর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত রোগীদের সুস্থ করার জন্য এ পেনিসিলিন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
মানব কল্যাণে নিজের এ আবিষ্কারের ব্যাপক প্রয়োগ দেখে আনন্দে অভিভূত হয়ে উঠেছিলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং।

১৯৪৫ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার এবং মানবকল্যাণে এর অসামান্য অবদানের জন্য আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। পুরষ্কার পেয়ে ফ্লেমিং কৌতুক করে বলেন, ‘এ পুরষ্কারটি ঈশ্বরের পাওয়া উচিত, কারণ তিনিই সবকিছুর আকস্মিক যোগাযোগ ঘটিয়েছেন।’

চিকিৎসা বিজ্ঞানের অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এই পেনিসিলিন। জীবনের ছোট্ট একটি ভুলের পুরষ্কার স্বরুপ আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ইতিহাসের পাতায় চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন। এর থেকে আমরা শিক্ষা পায় যে, ভুল থেকেও অনেক কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব।

This post was last modified on এপ্রিল ২৭, ২০১৮ 11:49 অপরাহ্ন

রায়হান মালিথা

Recent Posts

আপনি কী জনেন দিবানিদ্রার অভ্যাসে বাড়তে পারে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি!

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ দিনের বেলায় ঘুমানোকে আমরা ভাত ঘুম বলে থাকি। তবে দিনের…

% দিন আগে

ডিপিএস এসটিএস স্কুল ঢাকার ২০২৩-২৪ সেশনের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ডিপিএস এসটিএস সিনিয়র স্কুল অডিটোরিয়ামে আয়োজিত হয়েছে ডিপিএস এসটিএস স্কুল…

% দিন আগে

এসসিবি-চ্যানেল আই অ্যাগ্রো অ্যাওয়ার্ড ২০২৩: ‘সেরা কৃষি প্রতিষ্ঠান’ স্বীকৃতি পেলো আইফার্মার

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক অ্যান্ড চ্যানেল আই অ্যাগ্রো অ্যাওয়ার্ড ২০২৩- এর…

% দিন আগে

দেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রীর ছোটবেলার ছবি: বলুনতো এটি কে?

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ যে ছবিটি আপনারা দেখছেন সেটি দেশের জনপ্রিয় একজন অভিনেত্রীর ছোটবেলার…

% দিন আগে

ওয়ারেন্ট ঠেকাতে মরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: গ্রেফতার আতঙ্কে নেতানিয়াহু!

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ইসরায়েলের…

% দিন আগে

ছবিতে লুকিয়ে রয়েছে একটি কাঁচি: কেবলমাত্র বুদ্ধিমানেরাই ৩০ সেকেন্ডে খুঁজে বের করতে পারবেন!

দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ ছবিতে লুকিয়ে রয়েছে একটি কাঁচি। তবে এই কাঁচির প্রতিকৃতিটি এই…

% দিন আগে