দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বাঘ যার খেলার সঙ্গী এমন এক কিশোরের গল্প! এমন কথা শোনার পর যে কারও আজগুবি মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ঘটনাটি সত্য। একজন কিশোর যার নিত্যসঙ্গী হলো বাঘ!
ছবিতে এক হ্রদে এক জোড়া জাগুয়ারের সঙ্গে ১২ বছরের ব্রাজিলীয় কিশোর টিয়াগোকে দেখা যাচ্ছে। অনেকেই এটিকে বানোয়াট ছবিও মনে করতে পারেন। কিন্তু আসলে তা নয়। এটি বাস্তব দৃশ্য এবং এই কিশোর বাঘের সঙ্গেই তাকেন দিনের বেশির ভাগ সময়! এই বাঘদের মধ্যে একজন রীতিমতো কিশোর টিয়াগোর গলা জড়িয়ে ধরে রয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবিটি খুব জনপ্রিয় হওয়ায় অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে ছবিটি হয়তো ভুয়া।
পরে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, ছবিটি সঠিক এবং টিয়াগোর প্রায়ই এই ধরনের ছবি তুলে থাকে বাঘদের সঙ্গে। ব্রাজিলে জন্ম টিয়াগো সিলভিয়েরা শিশু বয়স হতেই জাগুয়ারদের সঙ্গে খেলাধূলা করে বড় হয়েছে। ওদের সঙ্গেই দিনের বেশিভাগ সময় কাটান টিয়াগো।
বিবিসি নিউজকে ব্রাজিলের এই ১২ বছরের কিশোর টিয়াগো বলেছে, ‘আমার কয়েকজন বন্ধু আমাকে বলেছিল ছবিটি ভুয়া। তবে সেটি ঠিক নয়, ছবিটি আসল ছবি। অনেকের কাছেই ছবিটিকে দারুণ ভালো লেগেছে এবং ওরা জাগুয়ার দুটোকে দেখতে চেয়েছে। সবাই তো আমার মতো ভাগ্যবান নয়, তাই ওদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে আমি ভাগ করে নিতে চাই।’
টিয়াগোর বাবা লিয়ান্দ্রো সিলভিয়েরা ও মা আনা জাকোমো দু’জনেই বিজ্ঞানী। ব্রাজিলের জাগুয়ার ইনস্টিটিউটে কাজ করেন তার বাবা-মা। তাদের মূল লক্ষ্যই হলো আমেরিকায় বাঘ, চিতাবাঘ, জাগুয়ার জাতীয় বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণা এবং তাদের সংরক্ষণ।
টিয়াগোর বাবা জানান, ‘আমাদের ছেলে এমন একটা পরিবেশে জন্মেছে, যেখানে শিশু বয়স থেকে সে জাগুয়ারদের সঙ্গেই বড় হয়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে চলতে হয় সেটাও খুব সহজাতভাবেই শিখেছে। আমরা অবশ্যই ওকে সবকিছুই করতে দিই না। তবে ও নিজেও জানে কী করা উচিত বা কি করা উচিত না।’
টিয়াগোর বাবা জানান, ওরা টিয়াগোর দৈনন্দিন জীবনেরই অংশ, ওর জীবনে এটা খুব অস্বাভাবিক কিছুই না। টিয়াগোর যখন জন্ম হয় তখন তার বাবা মা তিনটি জাগুয়ার ছানাকে বড় করছিলেন।
কোথাও বেড়াতে বেরুলে পথে তারা থামতেন চারটে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য। টিয়াগো ও তিনটি জাগুয়ার ছানা। ট্রাক নিয়ে বেড়াতে বের হতেন সিলভিয়েরার পরিবার। তাইতো বাঘ-জাতীয় পশুর সঙ্গে বড় হওয়ার বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছে টিয়াগোর।
এই বিষয়ে টিয়াগো বলেছেন, ‘আমাদের এটা ভালোবাসা ও সম্মানের একটা সম্পর্ক। জন্তু-জানোয়ারের দেখাশোনায় আমি বাবা-মাকে সব সময়ই সাহায্য করেছি। আমার ওদের সঙ্গ খুব ভালো লাগে।’
জাগুয়ারের মুখোমুখি হলে কী করতে হবে সিলভিয়েরা সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে যে সব পরামর্শ দিয়ে থাকেন, সে রকম একই পরামর্শ তিনি তার ছেলেকেও দিয়েছেন।
লিয়ান্দ্রো সিলভিয়েরা বলছিলেন, ‘এই ধরনের প্রাণীরা মানুষকে খাওয়ার জন্য মারে না। এরা যা করে তা শুধু মানুষের আচরণের প্রতিক্রিয়ায় করে থাকে। কাজেই তাদেরকে সম্মান দেখানো উচিত। ওদের শরীরের ভাষা দেখে আপনাকে বুঝতে হবে ওদের কতো কাছে যাবেন বা কতো কাছে যাবেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সীমারেখাটা কোথায় টানবেন সেটা আপনাকে আগে বুঝতে হবে। জাগুয়ার যদি সত্যিই আপনার সঙ্গ চায়, ও তখন নিজেই আপনার দিকে আসবে। এটা ঠিক ওরা সামাজিক প্রাণী নয়। তবে মানুষের সঙ্গে ওদের আজীবনের বন্ধন সব সময় গড়ে উঠতে পারে।’
টিয়াগোর মা বলেছেন, তার ছেলে ও জাগুয়ারদের নিয়ে তাকে আজ পর্যন্ত কোনোদিন বিপদে পড়তে হয়নি। তবে আনা জানিয়েছেন, তিনি তার ছেলেকে কখনও একা ছেড়ে দেননি জাগুয়ারদের সঙ্গে।
তিনি বলেছেন ঠিক এভাবে, ‘আমরা সব সময় জাগুয়ার ও অন্যান্য সব জন্তুদের ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করেছি। নিরাপত্তা নিয়ে আমরা খুবই কড়া নিয়ম-কানুনই মেনে চলি।’
তাদের ১২৩ একর জমির ওপর সিলভিয়েরা ও জাকামোর অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। তবে তারা পর্যটকদের সেখানে ঢুকতে দেন না। কারণ হলো তারা জন্তুদের বিরক্ত করতে চান না, তাদের সব সময় সম্মানে রাখতে চান।
২০০২ সালে তারা এই সংরক্ষিত এলাকা গড়ে তুলেছিলেন শুধুমাত্র জাগুয়ার নিয়ে গবেষণার জন্য। পরে ব্রাজিলের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংস্থার অনুরোধে তারা অনাথ জাগুয়ার ছানাগুলোর দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে তাদের অরণ্য এলাকা মূলত জাগুয়ারদের প্রজনন ভূমি হিসেবে পরিগণিত হয়।
সিলভিয়েরা বলেছেন যে, এই প্রজনন ও রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির ৯৫ শতাংশ অর্থই তারা ব্যক্তিগতভাবে দিয়ে থাকেন, বাকিটা আসে বিভিন্ন দানের অর্থ হতে। বর্তমানে তারা দেখাশোনা করছেন ১৪টি জাগুয়ার। এদের মধ্যে রয়েছে চারটি শিশু। এভাবে তারা গত এক দশকে বড় করেছেন ৩৫টি জন্তুকে।
দেশটির বিপন্ন প্রজাতির পশুর তালিকায় জাগুয়ারও রয়েছে। পৃথিবীর ২১টি দেশে জাগুয়ার পাওয়া যায়, তবে বিশ্বে মোট জাগুয়ারের প্রায় অর্ধেকই রয়েছে ব্রাজিলে।
তাদের সংরক্ষণ ভূমিতে যে সকল জাগুয়ার আসে তাদের ওরা আর বনে ফেরত পাঠায় না। কারণ হলো কৃষকরা তাদের গরু-ছাগল বা ভেড়া বাঁচাতে জাগুয়ারদের মেরে ফেলে।
এই সব জাগুয়ার মানুষের সঙ্গে বড় হওয়ার কারণে মানুষের সঙ্গে তাদের একটা ঘনিষ্ঠ বন্ধন গড়ে ওঠেছে। সিলভিয়েরা মনে করেন, ওদের জঙ্গলে ছেড়ে এলে ওরা মানুষের খোঁজে লোকালয়ে চলে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের হাতেই প্রাণ হারাবে।