দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ দেশীয় কৃষ্টি-কালচার থেকে সরে গিয়ে বিদেশী বিশেষ করে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রতি আমাদের এতো দুর্বলতা কেনো সেটি আগে ভেবে দেখা উচিত। কারণ খুঁজে পেলে সমাধানও আসবে।
বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভারতীয় টিভি চ্যানেল বিশেষ করে স্টার জলসা ও জি বাংলা কেনো এতো জনপ্রিয়? যদি কাওকে এই প্রশ্ন করা যায় তাহলে একেক জন একেকভাবে জবাব দেবেন। কিন্তু প্রকৃত কারণের কাছে কেও যাবে না।
বিভিন্ন সময় আমাদের দেশের টিভি মালিকরা নানাভাবে অভিযোগ করে ভারতীয় টিভি চ্যানেল বন্ধের দাবি তুলেছেন। কিন্তু কেনো? ঘরের জিনিস রেখে মানুষ কেনো আরেক বাড়ির জিনিস খেতে যাবে? এর কারণ বের না করে তারা লম্ফঝশ্ফ করেন। আসল কারণ খুঁজে বের করলে তবেই না সমাধান হবে।
হঠাৎ করেই ভারতীয় জি বাংলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। প্রায় ২৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশে আবারও ভারতীয় টেলিভিশন জি নেটওয়ার্কের চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার শুরু হয়। গত বুধবার দুপুর থেকেই চ্যানেলগুলো আবার দেখা যায়।
তারআগে সোমবার হতে বাংলাদেশে জি বাংলাসহ সকল জি নেটওয়ার্কের সকল চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনাও শুরু হয়।
জি-নেটওয়ার্কের চ্যানেল জি-বাংলা বাংলাদেশে কেনো এতো জনপ্রিয়। বাংলাদেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান কেনো দর্শকদের টানতে পারছে না, কেনো বাংলাদেশের টিভি দর্শকরা ভারতীয় চ্যানেলমুখী, তা নিয়েও গত বেশ কয়েক বছর ধরেই আলোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে। কিন্তু তার কোনো সমাধান আসেনি।
কয়েক বছর পূর্বে করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের এক জরিপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে নারীরা ৯০ শতাংশ টেলিভিশন দেখেন। যদিও এদের ৬০ শতাংশই দেখেন স্টার জলসাসহ ভারতীয় বাংলা চ্যানেল। কেনো ভারতীয় চ্যানেল পছন্দ করেন দর্শকরা, কেনো বাংলাদেশের অনুষ্ঠান তাদের আকর্ষণ করেনা? এই প্রশ্ন উঠে আসে।
বাংলাদেশের টিভি দর্শকদের বড় অংশের কাছে ভারতের বাংলা চ্যানেলগুলোর দৈনিক সোপ অপেরাগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। এগুলোর দর্শক প্রধানত নারী এবং অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ নারী-পুরুষরা দেখেন। আরেকটি অংশের কাছে জনপ্রিয় হলো বিভিন্ন খেলাধুলার চ্যানেল, এগুলোর দর্শকদের বড় অংশটি তরুণ এবং নানা বয়সের পুরুষও রয়েছে।
তবে বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে দেশি টিভি অনুষ্ঠানের চেয়ে কেনো ভারতের চ্যানেল জনপ্রিয়, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যাপক সংখ্যক দর্শক বিজ্ঞাপন আধিক্যের অভিযোগই তুলেছেন।
নাজিয়া পারভীন নামে জনৈক গৃহিনী বলেছেন, ভারতীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন কম। “তাছাড়া ওদের প্রতিটা অনুষ্ঠানের পেছনে ওরা প্রচুর অর্থ খরচ করে, মানে ওদের কাপড়চোপড়, গৃহসজ্জা এসবে অনেক মনোযোগ দেয়, যা দেখতে ভালো লাগে।
“এর বাইরেও ওদের বাচনভঙ্গিও আমার কাছে যথার্থ মনে হয়। যেমন ওরা আইছস-গেছস বলে না, তবে বাংলাদেশের নাটকে দেখবেন কাজের ছেলেও যে ভাষা বলে নাটকের নায়কও সেই একই ভাষায় কথা বলে।”
বিবিসি বাংলার ফেসবুক পাতায় অতুল কুমার লিখেছেন যে, “আসলে আমাদের দেশের চ্যানেলগুলো যেদিন থেকে মেয়েদের মন বুঝে প্রোগ্রাম বানাতে সক্ষম হবে, সেদিন থেকে আর আমাদের বিদেশি চ্যানেল বিশেষ করে স্টার জলসা ও জি’টিভির উপর আর ক্ষোভ ঝাড়তে হবে না। রুচি সম্মত অনুষ্ঠান না বানালে আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলোকে এইরকম দর্শকের পিছনে ঘোড়ঝাঁপ করেই বেড়ানো লাগবে!”
আল মামুন নামে একজন বলেছেন, “পার্থক্য হলো বাংলাদেশের চ্যানেলে বস্তা ভরা এ্যাড।”
রাসেব মল্লিক নামে আরেকজন বলেছেন, “মূল পার্থক্য হলো ভারতীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন কম, আর সিরিয়ালগুলো প্রতিদিন চলে তাই যারা দেখে তাদের একটা এডিকশন হয়ে যায়, যদিও সেটা ক্ষতিকর।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা নীরা বলেছেন, ভারতীয় সোপগুলোতে দেখানো ‘ফ্যান্টাসি’ দেখতে পছন্দ করেন দর্শকরা।
“রূপকথার গল্পের মতন যেসব ফ্যান্টাসি সেসব চ্যানেলে দেখানো হয়, সেটা বাংলাদেশে হয় না। যেমন ঘরের মধ্যে অনেক গয়না-গাটি পরে বসে আছে, কিংবা অসম্ভব সাংসারিক একটা ষড়যন্ত্র দেখানো হচ্ছে।”
“আমার মনে হয়, মানুষ নিজের বাস্তব জীবনের বাইরে বেরিয়ে একটা ফ্যান্টাসির দুনিয়া সব সময় দেখতে চায়, যেটা তাকে হালকা একটা বিনোদনও দেবে। তাছাড়া সময়সূচীও একটা ব্যাপার রয়েছে, যেমন নির্দিষ্ট করে রবিবার-সোমবার মনে রাখতে হয় না।”
তবে তিনিও বিজ্ঞাপন আধিক্যের কারণকেই উল্লেখ করেছেন। বলেছেন তার ভাষায়, দর্শকের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
কারণ হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশের একটি চ্যানেলে যদি ১০ মিনিট অনুষ্ঠান হয় আর ১০ মিনিট বা কখনও কখনও তার থেকেও বেশি সময় ধরে বিজ্ঞাপন হয়। সে কারণে দর্শকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়। অথচ ভারতীয় চ্যানেলগুলো ৩ থেকে ৪ মিনিট করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। আধা ঘণ্টার একটি সিরিয়ালে দু’বার মাত্র নির্ধারিত বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এতে দর্শকদের আগ্রহ থাকে বেশি। আর তাছাড়া প্রতিদিন একটি কাহিনী দেখতে পায় দর্শকরা। আর বাংলাদেশের টিভিগুলোর দর্শকদের সিরিয়াল নাটক দেখতে হলে একটি কাহিনী দেখার পর আবার অপেক্ষা করতে হবে অন্তত ৭ দিন! তবে বিজ্ঞাপনের আধিক্যের কারণটিই এখানে বেশি কাজ করে বলে মনে হয়। এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দিলে তাহলে আন্দোলন করে বা জোর করে দর্শককে টেনে নিয়ে আসার কোনো প্রয়োজন পড়বে না। দর্শকরা একা একাই চলে আসবে দেশীয় টিভি চ্যানেল দেখার জন্য।