দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আজ এক রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ আজ জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় দেন।
বেলা ১১টার দিকে বিচারক তার রায় প্রদান শুরু করেন এবং ২৪৩ পৃষ্ঠার মূল রায়ের সার সংক্ষেপ পড়ে শোনানো হয়। বেলা ২টার কিছু আগে চূড়ান্ত রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেন। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও বয়সের কথা বিবেচনা করে আদালত এই রায় দেয়। আদালত ৫টি মামলায় সব মিলিয়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেছে।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ১ নম্বর ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলায় রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি হয়। ওই সময় রাষ্ট্রপক্ষ গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে। আসামিপক্ষ তাঁকে খালাস দেওয়ার দাবি করে।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২২ নভেম্বর গোলাম আযম পাকিস্তানে পালিয়ে যান। ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্টে তিন মাসের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এরপর আর ফিরে যাননি।
বিচার যেভাবে শুরু
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন গঠন করা হয়। তদন্ত সংস্থা ২০১০ সালের ১ আগস্ট গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। তবে তা ‘অবিন্যস্ত’ ও ‘অগোছালো’ উলেস্নখ করে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ পুনরায় দাখিলের নির্দেশ দেন। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ পুনরায় দাখিল করলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নিয়ে গত বছরের ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে হাজির হতে বলেন। সে অনুযায়ী তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন জানালে তা খারিজ করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। তবে পরে বার্ধক্যজনিত কারণে তাঁকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের কারাকক্ষে রাখা হয়। ১৩ মে তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ১ জুলাই থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন ১৬ জন, আসামিপক্ষে একজন। চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়।
যত অভিযোগ
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এগুলো হলো- মানবতাবিরোধী অপরাধ ও এর অনুরূপ আন্তর্জাতিক অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, সহযোগিতা এবং হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ। পাঁটিটি অভিযোগে ৬১টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬২টি ঘটনা উল্লেখ করেছিল।
১. ষড়যন্ত্রের অভিযোগ : গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত প্রথম অভিযোগটি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে ষড়যন্ত্রের। এই অভিযোগে ছয়টি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে একাত্তরের ৪ এপ্রিল গোলাম আযম, নুরুল আমীন, মৌলভী ফরিদ আহমেদ, খাজা খয়েরউদ্দিন, এ কে এম শফিকুল ইসলাম, মাওলান নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, মোহসিন উদ্দিন আহমেদ, এ টি সাদীসহ ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের ষড়যন্ত্র করেন। এই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক করে মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলা করতে রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
২. পরিকল্পনার অভিযোগ : দ্বিতীয় অভিযোগে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে তিনটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ এপ্রিল গোলাম আযম ও অন্যরা ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন। এলিফ্যান্ট রোডে এ কিউ এম শফিকুল ইসলামের বাসভবনে খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির সভা হয়, যেখানে গোলাম আযম উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনের বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়।
৩. উসকানির অভিযোগ : গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত তৃতীয় অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানির ২৮টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে ৭ এপ্রিল গোলাম আযম এক বিবৃতিতে স্বাধীনতাকামী মানুষকে ‘ভারতীয় অনুপবেশকারী’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তাদের যেখানেই দেখা যাবে, সেখানেই ধ্বংস করা হবে। ২২ এপ্রিল শান্তি কমিটির সভা শেষে এক বিবৃতিতে তিনি অধীন সংগঠনগুলোর সদস্যদের ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক’ উল্লেখ করে দেশের সাধারণ নাগরিকদের ধ্বংস করার আহ্বান জানান। তিনি ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ কার্যকলাপের প্রশংসা করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাসঘাতক বলেন আর তাঁদের কাজকে রাষ্ট্রবিরোধী কাজ হিসেবে আখ্যা দেন। একাত্তরে রাজশাহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা, কুষ্টিয়া প্রভৃতি এলাকায় আয়োজিত সভায় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক ও উত্তেজনাকর বক্তব্য দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে সভা করে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে রাজাকার, আলবদরদের খেপিয়ে তোলেন।
৪. সহযোগিতার অভিযোগ : গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত চতুর্থ অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা বা সম্পৃক্ততার ২৩টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। ৪ ও ৬ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে গোলাম আযমসহ অন্যরা সহযোগিতার আশ্বাস দেন। শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে তিনি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানান।
৫. হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ : গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগে হত্যা ও নির্যাতনের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের সিরু মিয়া একাত্তরে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় দারোগা (সাব-ইন্সপেক্টর) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ তিনি স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ও ১৪ বছরের ছেলে আনোয়ার কামালকে নিয়ে কুমিল্লার নিজ বাড়িতে যান। সেখানে সিরু মিয়া শরণার্থীদের ভারতে যাতায়াতে সাহায্য করতেন। ২৭ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে কসবা থানার তন্তর চেকপোস্টের কাছে সিরু মিয়া ও তাঁর ছেলেসহ ছয়জন ভারতে যাওয়ার সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে কয়েক দিন নির্যাতনের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। স্বামী-সন্তানের ধরা পড়ার খবর পেয়ে সিরু মিয়ার স্ত্রী গোলাম আযমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সিরু মিয়ার ভগ্নিপতি ছিলেন গোলাম আযমের দুই ছেলের শিক্ষক। তিনি গোলাম আযমের কাছে সিরু মিয়া ও তাঁর ছেলেকে মুক্তি দিতে অনুরোধ জানান। গোলাম আযম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তি কমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে একটি চিঠি পাঠান, যাতে সিরু মিয়া ও তাঁর ছেলেকে হত্যার নির্দেশ ছিল। চিঠি পাওয়ার পর ঈদের দিন রাতে সিরু মিয়াসহ ৩৯ জনকে পাকিস্তানি সেনারা রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় কারাগার থেকে বের করে পৈরতলা রেলব্রিজের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ৩৮ জন মারা গেলেও একজন প্রাণে বেঁচে যান।
উল্লেখ্য, ফরিদপুরে বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির রায়ের মধ্য দিয়ে গত ২১ জানুয়ারি শুরু হয় জাতির সবচেয়ে বড় কলঙ্কমোচনের পালা। এরপর একে একে রায় ঘোষিত হয় মিরপুরের কসাই নামে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, পিরোজপুরে দেইল্লা রাজাকার নামে পরিচিত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলার।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষে গত ১৭ এপ্রিল এটি রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ১ নম্বর ট্রাইব্যুনাল।