দি ঢাকা টাইমস ডেস্ক ॥ ইন্টারনেট হতে সব তথ্য কী মুছে ফেলা সম্ভব? এমন প্রশ্ন এবার উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, ‘ভবিষ্যতে ইন্টারনেটে সবাই অন্তত ১৫ মিনিটের জন্য হলেও বেনামী হয়ে যাবে।’ সম্প্রতি এমনই এক মন্তব্য করেছেন বিখ্যাত চিত্র শিল্পী ব্যাঙ্কসি।
প্রশ্ন ওঠে যে, ইন্টারনেটের এই যুগে আজকাল মানুষ যেভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক হতে শুরু করে কোথায় ছুটি কাটাতে যাবে সে সম্পর্কেও অনলাইনে পোস্ট করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন, তখন কী আসলেও এভাবে ক্ষণিক সময়ের জন্য হলেও সবার পক্ষে বেনামী হওয়া সম্ভব হবে?
এই মন্তব্যটিও অ্যান্ডি ওয়ারহলের ‘ফিফটিন মিনিটস অব ফেম’ লাইনটির মতো অনেক ধরণের অর্থবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সমালোচকরা।
২১ শতকে এসে কোনো কিছু গোপন রাখা যে রীতিমতো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে -এই বিষয়টি সেই বিষয়টিকেই সামনে নিয়ে এসেছে।
এই বিষয়ে অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ভিক্টর মায়ের-শোয়েনবের্গের বলেছেন, “বর্তমানে আমাদের কাছে অনেক ধরণের ডিজিটাল ডিভাইস রয়েছে যাতে করে অনেক ধরণের সেন্সর বসানো থাকে। এই সেন্সরগুলো আমাদের সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য ধারণ করতে সক্ষম।”
তবে এটা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্যারিয়ারবিল্ডার নামে একটি নিয়োগ সংস্থার জরিপ মতে, গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭০ ভাগ কোম্পানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশ্লেষণ করে চাকরি প্রার্থীদের বাছাই করেছে। ৪৮% কোম্পানি তাদের বর্তমান কর্মকর্তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কর্মকাণ্ডের উপর নজর রাখে।
বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো, ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রোফাইলে খোঁজ-খবর করতে থাকেন।
ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ধরণের কোম্পানি, ক্রেতাদের ক্রয় অভ্যাস ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মডেল তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে থাকে। অনেক সময় এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারও সহায়তা নেওয়া হয়েছে।
এমন এক পরিস্থিতি হতে বাঁচার একটি উপায় হচ্ছে- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের প্রোফাইল ডিলিট কিংবা মুছে ফেলা। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির পর অনেকেই এই কাজটি করেছিলেন। ওই ঘটনায় ৮ কোটি ৭০ লাখের মতো মানুষের ফেসবুকের তথ্য রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের সুবিধার জন্য গোপনে ব্যবহার করা হয়।
ব্যক্তিগত তথ্য মুছে ফেলার অন্যতম একটি উপায় হিসেবে দেখা হয় যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট ডিলিট করাকে। তবে এর ফলে অন্যান্য কোম্পানির হাতে থাকা তথ্য মুছে ফেলার ক্ষেত্রে এটি তেমন কোনো কাজেই আসবে না। তবে সৌভাগ্যবশত, বিশ্বের অনেক দেশে এই বিষয়ে সহায়তার জন্য আইনও রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাধারণ তথ্য সুরক্ষা নীতি কিংবা (GDPR) অনুযায়ী, “রাইট টু বি ফরগটেন বা বিস্মৃত হওয়ার অধিকার” রয়েছে- অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি চাইলে তার নিজের ব্যক্তিগত তথ্য মুছেও ফেলতে পারেন।
যুক্তরাজ্যে এই বিষয়টি তদারকি করে তথ্য কমিশনারের কার্যালয়। বিবিসিকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নিজের সব তথ্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে মুছে ফেলার ৫৪১টি আবেদন জমা পড়ে। যে সংখ্যা এর আগের বছর ছিলো ৪২৫টি ও ২০১৬-১৭ সালে ছিলো ৩০৩টির মতো।
তবে ব্রিটিশ তথ্য কমিশনারের কার্যালয় (আইসিও) দাবি করেছে যে, এই প্রকৃত সংখ্যা আসলে আরও বেশি হবে। কারণ হলো, ওই সব আবেদনের বিষয়ে তালিকায় উল্লেখ করা হয় যে, যেগুলোর তথ্য মুছে ফেলতে অসম্মতি জানানোর পর এই বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়।
আইসিও’র কর্মকর্তা সুজান গর্ডন বলেছেন, এটি আসলে পরিষ্কারভাবে বলা সম্ভব না। “কেও যদি মনে করে যে, কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা তার সম্পর্কিত কোনো তথ্য আর কাজেই লাগবে না, তখন সে তার ওই তথ্য মুছে ফেলার অধিকারকে অনেক বেশি করে শক্তিশালী করেছে জিডিপিআর।”
“যাই হোক এই অধিকারটি আসলে শর্তহীন নয়। কারণ হলো, অনেক ক্ষেত্রেই এটি অন্য কোনো বা কারও অধিকার এবং স্বার্থ বিরোধী কিনা সেটারও ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা।”
“বিস্মৃত হওয়ার অধিকার” ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে ২০১৪ সাল থেকে এবং যে কারণে ব্যাপক হারে তথ্য মুছে ফেলার আবেদন আসতে শুরু করে সেই সময়। সর্ব প্রথম এই ধরণের আবেদন করেন সাবেক এক রাজনীতিবিদ যিনি পুনঃনির্বাচন করতে চেয়েছিলেন ও তার বিরুদ্ধে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়। তবে এই ধরণের সব আবেদন অনুমোদন হয়নি।
এক্ষেত্রে ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের টাকা রয়েছে তারা নিজেদের সহায়তায় বিশেষজ্ঞ ভাড়া করে এই কাজটি করেছেন।
এই সুনাম প্রতিরক্ষা বা ‘রেপুটেশন ডিফেন্স’ নিয়ে পুরো একটি শিল্পখাত তৈরি করা হয়েছে। অনেক ফার্ম রয়েছে যারা টাকার বিনিময়ে সবতথ্য মুছে ফেলার জন্য বিভিন্ন ধরণের প্রযুক্তি প্রস্তুতও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এরা সার্চ ইঞ্জিন হতে খারাপ সংবাদ মুছে ফেলার কাজও করে।
এই ধরণের একটি প্রতিষ্ঠান, ডিফেন্স ডিফেন্ডার ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে যে, তাদের কাছে অন্তত ১০ লাখ গ্রাহক রয়েছে যাদের মধ্যে রয়েছেন ধনী ব্যক্তি, পেশাজীবী ও প্রধান নির্বাহীরা। প্রতিষ্ঠানটির একেকটি প্যাকেজ সেবার জন্য ৫ হাজার পাউন্ড কিংবা সাড়ে ৫ হাজার ডলার নিয়ে থাকে।
এই প্রতিষ্ঠানটিই তাদের গ্রাহকদের তথ্য খোঁজার ফল গুগল সার্চে পরিবর্তন করে দেওয়ার জন্য নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে গুগলে অনুসন্ধান করলে ওই গ্রাহকদের সম্পর্কিত নেতিবাচক তথ্য কম ও ইতিবাচক তথ্য বেশি থাকে।
“এই প্রযুক্তি, অনুসন্ধান করার ফলাফলে ওয়েবসাইটগুলোকে ক্রমানুসারে সাজাতে হয়, গুগল কি ধরণের তথ্যের উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে তার উপর ফোকাস করে,” বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক টনি ম্যাকক্রিস্টাল।
তিনি আরও বলেন, “সাধারণত দুটি বিষয়কে গুগল গুরুত্ব দেয়, একটি ওয়েব অ্যাসেটের বিশ্বাসযোগ্যতা ও কর্তৃত্ব আর অপরটি হচ্ছে, তথ্য অনুসন্ধানের ফলের সাথে ব্যবহারকারীরা কিভাবে সংশ্লিষ্ট হয় তা গুগল যেভাবেই লক্ষ্য করে থাকে।”
অধ্যাপক মায়ের শোয়েনবের্গের বলেন, “ইন্টারনেট সেবা ব্যবহারকারী সকল ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান যতোক্ষণ পর্যন্ত তাদের পরিচালনা পদ্ধতি পরিবর্তন করতে বাধ্য না হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত ইন্টারনেট হতে পুরোপুরিভাবে কারও সব ব্যক্তিগত তথ্য মুছে ফেলা সম্ভব নয়।”
তিনি বলেছেন, “ভোক্তার ব্যক্তিগত তথ্য কিভাবে সংগ্রহ, বিনিময় ও বিক্রি হবে সে সম্পর্কে বলার মতো অধিকার প্রতিষ্ঠায় শক্ত কোনো আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত বর্তমানে বিদ্যমান গোপনীয়তার ভারসাম্যের অভাবকে কখনই সামনে আনা সম্ভব হবে না।” তথ্যসূত্র- বিবিসি।