দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমে ৪ বছর গর্তে আটকে থাকা জনৈক কাদেরের রহস্যঘেরা কাহিনী উঠে এসেছে। নেট দুনিয়ায় ওই বিষয়টি বলা যায় ভাইরাল হয়েছে।
কিন্তু আসলে ওই কাদের কে? কী তার পরিচয়? কেনোই বা তিনি এমন কাজ করেছেন? এমন নানা প্রশ্ন মানুষের মনে উকি দিচ্ছে। জানা যায় যে, তিনি বাংলা-ইংরেজি দুই ভাষাতেই সমানে লিখতে পড়তে পারেন। শুদ্ধ সুন্দর করে কথাও বলতে পারেন। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে তিনি হেঁটেছেন উচ্চশিক্ষার পথেও। অথচ ভাগ্যবিড়ম্বিত কাদেরের জীবন বর্তমানে আটকে গেছে একটি গর্ত এবং তার ভেতরে পড়ে থাকা মেহগনি গাছের গুঁড়ির মধ্যে। কিন্তু কেনো?
সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়, আব্দুল কাদের হলেন একজন মানসিক প্রতিবন্ধী। বয়স হবে প্রায় ৫৩ বছর। বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের শাহাজাতপুর গ্রামে। পাইকগাছার রাড়ুলি আর.কে.বি.কে হরিশচন্দ্র কলেজিয়েট ইন্সটিটিউট হতে তিনি ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৮৫ সালে কপিলমুনি কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর একই কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় আকস্মিকভাবে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটে কাদেরের।
পারিবারিক সূত্র জানা যায় যে, তালা উপজেলার শাহাজাতপুর গ্রামের শওকত আলী মোড়লের তিন ছেলে এবং তিন মেয়ের মধ্যে আব্দুল কাদের সবার বড়। একসময় পারিবারিক সচ্ছলতা ভালো না থাকলেও শওকতের বিদ্যানুরাগী মনোভাব সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে অনুপ্রাণিত করেছিলো। তবে ভাগ্য বিড়ম্বিত আব্দুল কাদেরকে আর এগুতে দেয়নি তার নির্মম নিয়তি। জমি-জমা সংক্রান্ত একটি পারিবারিক বিরোধ আকস্মিকভাবে থমকে দেয় তার গতিময় জীবনকে। যার জের ধরে তারই এক চাচাতো ভাই তাকে হত্যার উদ্দেশে তাল কাঠের রুল দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। এতে সে প্রাণে বেঁচে গেলেও চরমভাবে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটে কাদেরের।
তারপর সর্বস্ব বিক্রি করে চিকিত্সা করায় সেবারের মতো প্রাণে বেঁচে গেলেও ভালো হয়ে ওঠেননি আব্দুল কাদের। বন্ধ হয়ে যায় তার পড়া-লেখাও। তারপর কিছুদিন যেতে না যেতেই ঘটতে থাকে আকস্মিক মাথায় গণ্ডগোল, স্থানীয় চিকিত্সায় আবার ভালোও হয়ে ওঠে। এলাকাবাসীর পরামর্শে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত আসে হয়তো বিয়ে দিলে দাম্পত্য জীবনে মস্তিষ্কের সফলতা অসতে পারে। তাই বিয়েও দেওয়া হয় তাছলিমা নামে এক মেয়ের সঙ্গে। দাম্পত্য জীবনে এক মেয়ে ফাতেমার জন্মও হয়। তবে মেয়ের জন্মের কিছুদিন পর তার স্ত্রী তাছলিমার মৃত্যু ঘটে। নিঃসঙ্গতায় আবার পাগলপ্রায় অবস্থা হয় কাদেরের। তারপর আবার তাকে জুলেখা নামে এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। নতুন করে দাম্পত্য জীবনে তাদের আবার দু’কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। যার একজন আসমা খাতুন এবং অপরজন ফাইম খাতুন।
আব্দুর কাদেরের দাম্পত্য জীবন শুরু হলেও মোটেও সুখের হয়নি। ছোট মেয়ে ফাইমার জন্মের পরেই একেবারেই বিগড়ে যান আব্দুল কাদের। স্বজনদের ধরে মারপিট, ভাঙচুর এবং প্রতিবেশীদের ক্ষতিসাধন শুরু করতে থাকেন কাদের। প্রতিদিন বাড়তে থাকে তার ওই পাগলামি।
একপর্যায়ে পরিবারের সদস্যরা বাধ্য হয়েই তাকে প্রথমে বারান্দায় হাতে-পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন। তবে সারাক্ষণ উচ্চস্বরে চিত্কার এবং অশ্লীল বাক্যবাণে বিরক্ত হয়ে পরিবারের লোকজন বাড়ি হতে প্রায় ৩০০ ফুট দূরে বাগানের মধ্যে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা শুরু করেন। বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের ফেলে এখন তার ঠাঁই হয়েছে বাড়ির পাশের বাগানের মধ্যে অন্ধকার একটি গর্তে। রাত-দিন ঝড়-বৃষ্টিতে এক হাত ও পায়ে শিকলে বাঁধা পড়েছে তার গদ্যময় এই নিঃসঙ্গ জীবন। সব আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সাধ আটকে গেছে আঁটসাঁট একটি গর্ত এবং তার উপর পড়ে থাকা একটি ছোট মেহগনি গাছের উপরেই! এভাবেই গত প্রায় ৪টি বছর অন্ধকার গর্তেই নিঃসঙ্গতায় কাটছে আব্দুল কাদেরের জীবন।
সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গেলে চিরাচরিত স্বভাবেই দেখা গেছে তাকে। তবে কথোপকথনে তাকে মোটেও মস্তিষ্ক বিকৃত বলে মনে হয়নি। প্রথম দেখাতেই সাংবাদিকদের দেখে সালাম দেন কাদের। তারপর একে একে তার জীবনের সব ঘটনার নির্ভুল বর্ণনা দিতে থাকেন কাদের। কখনও পুরনোকে মনে করে আবেগ আপ্লুত হতেও দেখা যায় তাকে। এই সময় তিনি তার শৈশব-কৈশোরের সব স্মৃতির রোমন্থনও করতে থাকেন। তবে তাকে করা সব প্রশ্নের উত্তর দেন মধুর কণ্ঠে এবং সুরে সুরে। তবে কথার ফাঁকে ফাঁকে নিজের শিকলে বাঁধা জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও মুক্তির আকুতি জানান কাদের।
আব্দুল কাদের বলেছেন, আপনারা জানেন? আমি আমার ৪ বছরের মেয়ে ফাইমাকে কখনও কোলে নেয়নি, আদর করা হয়নি কখনও তাকে। আমাকে দূর থেকে দেখেই ভয়ে পালিয়ে যায় বলে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন কাদের।
কোনো একপর্যায়ে তার সরল স্বীকারোক্তির নির্ভুলতা যাচাই করতে তার ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি মুখে সুরে সুরে বলার পাশাপাশি খাতা-কলম চান লিখে দেওয়ার জন্য। তারপর ইংরেজিতে লেখেন তার বায়োডাটা। তবে কেনো একজন সুস্থ-সবল মানুষকে ৪ বছর এভাবেই বেঁধে রাখা হযেছে? এমন প্রশ্ন করতেই কাদেরের মা এবং স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয়ে যায় চোখাচোখি, কানাকানিসহ নানা ইশারাও করেন তারা নিজেদের মধ্যে। যেনো কিছু একটা গোপন করতে চাওয়া। প্রশ্ন ওঠে তবে কেনো তাদের এই গোপনীয়তা? নাকি এটি নীরবতা? মুহূর্তে নানান কেনো বার বার উঁকি দিতে থাকে মনে।
একপর্যায়ে কাদেরের মা রহিমা বেগম (৭০) ছেলের উপর ঘটে যাওয়া নানা নির্যাতনের বর্ণনা শুরু করার পর স্ত্রী জুলেখা তাতে বাঁধ সাধেন। যেনো তাদের চোখে-মুখে তখন অন্য রকম এক ভীতি যেনো কাজ করছিল। মনো হলো কিছু একটা গোপন করতে চাইছেন তারা। তবে কথোপকথনের একপর্যায়ে মৃতপ্রায় কাদেরের একেবারে মৃত্যুর শঙ্কাটি বার বার সামনে উঠে আসে। তবে কিসের সেই শঙ্কা তাদের? ব্যাপক তথ্যানুসন্ধানে উঠে আসতে পারে অনেক তথ্য।
এই বিষয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান প্রভাষক রাজিব হোসেন রাজু বলেন, এমন অবস্থায় একজন মানুষ তার ইউনিয়নে নির্মম জীবন-যাপন করছেন তা তার জানাই ছিল না। সম্প্রতি স্থানীয় এক ফায়ার সার্ভিস কর্মীর সহযোগিতায় দেখতে গেছেন তাকে। তাৎক্ষণিক সহযোগিতাও করেছেন। আব্দুল কাদেরের জন্য ভবিষ্যতে কিছু করার মানসিকতাও পোষণ করেন ইউপি চেয়ারম্যান।
এমন এক পরিস্থিতিতে এলাকাবাসীর পাশাপাশি পরিবারের দাবি, সুচিকিৎসায় সুস্থ্য জীবনে ফিরতে পারে আব্দুল কাদের। ফিরে পেতে পারেন তার স্বাভাবিক জীবন। তবে সে জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তারও। সেজন্য তারা বিত্তবানদের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতাও কামনা করেছেন। তথ্যসূত্র: ইত্তেফাক।