দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ এক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির শিকার সিরিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সারাবিশ্ব। কারণ ইতিমধ্যেই মার্কিন বাহিনী সিরিয়ায় হামলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান রেখে সিরিয়া বলেছে, হামলা ভোটে বিচক্ষণ হোন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শনিবার সিরিয়া হামলার ব্যাপারে কংগ্রেসের আইনপ্রণেতাদের সিদ্ধান্ত নেবেন বলে ঘোষণা দেয়ার পর রোববার সিরিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল মুকদাদ সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। এ সময় তিনি ২১ আগস্ট রাসায়নিক হামলার অভিযোগ সরকারের পক্ষ থেকে আবারও প্রত্যাখ্যান করেন।
ফয়সাল মুকদাদ আরও বলেন, ফ্রান্স সরকার সিরিয়া হামলার ব্যাপারে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে। হামলার জন্য ফরাসিদের সমর্থন আদায়ে তাদের সরকার প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। এদিকে সিরিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী কাদরি জামিল বলেছেন, তার দেশের বিরুদ্ধে মার্কিন আগ্রাসনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। তিনি লেবাননের আল-মিয়াদিন টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সিরিয়ায় মার্কিন হামলার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, তার দেশের সেনাবাহিনী আগ্রাসী শক্তির দাঁতভাঙা জবাব দেবে। যুদ্ধ পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ওবামার সিদ্ধান্ত থেকে মার্কিন কর্মকর্তাদের হতাশার চিত্র ফুটে উঠেছে- উল্লেখ করে সিরিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মার্কিন কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার বিষয়টিও স্বীকার করে নেয়া উচিত। তিনি বলেন, আমেরিকার বর্তমান অবস্থা দেখে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার প্রভাব কমে গেছে এবং দেশটি সব ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।
এদিকে জাতিসংঘের অনুমতি থাকলেই সিরিয়ায় সামরিক অভিযানকে সমর্থন দেবে ভারত। জাতিসংঘের বাইরে গিয়ে যদি যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় অভিযান চালায় তাতে সমর্থন জানাবে না ভারত। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ওয়াশিংটন সফরের আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ সিরিয়া প্রসঙ্গে পশ্চিমাদের তোড়জোড় নিয়ে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানালেন। তিনি বলেছেন, সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালাতে হলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাগবে। তখনই ভারত তাতে সমর্থন দেবে। দামেস্কে রাসায়নিক হামলায় কয়েকশ’ মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারের দায়ী করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিকল্পনা বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ শনিবার বলেন, আমরা এমন কোনো অভিযানে সমর্থন দিতে পারি না, যেখানে জাতিসংঘের অনুমোদন নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে এফবি আই’র নজরদারিতে সিরীয়রা
সিরিয়ায় সম্ভাব্য মার্কিন সেনা অভিযানকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সিরীয়দের নজরদারিতে রেখেছে দেশটির আভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এফবি আই। রোববার নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়। আভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ও ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় হামলা চালালে প্রতিক্রিয়া হিসেবে সাইবার হামলা হতে পারে। রোববার এএফপি এ তথ্য জানিয়েছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সমর্থক সিরিয়ান ইলেক্ট্রনিক আর্মি টাইমসসহ বেশ কয়েকটি আমেরিকান কোম্পানিতে সাইবার হামলা চালিয়েছে। পত্রিকাটি জানায়, আগামী দিনগুলোতে এফবি আই’র এজেন্টরা কয়েকশ’ সিরীয়র সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েছে। সিরিয়ায় যে কোনো ধরনের সামরিক আগ্রাসন চালানো হলে ইসরাইলে হামলা করা হবে বলে সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরান হুশিয়ার করায় মার্কিন কর্মকর্তারা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন।
৩ সপ্তাহ লাগবে নমুনা পরীক্ষায়
সিরিয়ায় রাসায়নিক হামলার সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার জন্য ৩ সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল। হামলার স্থান থেকে সংগ্রহ করা নমুনা এখন ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষাধীন রয়েছে। সঠিক নিয়ম মেনে বস্তুনিষ্ঠভাবে এর ফলাফল হাতে পেতে লাগবে তিন সপ্তাহ এমনটিই দাবি করেছে জাতিসংঘ রাসায়নিক অস্ত্র নিরোধ সংস্থা। ফলাফল পাওয়া মাত্রই তা জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের হাতে তুলে দেয়া হবে।
সিরিয়া হামলা নিয়ে প্রতিবেশীদের প্রস্তুতি
সারাবিশ্বেই এখন সিরিয়া নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কারণ সম্ভাব্য মার্কিনী হামলার শিকার যাতে সাধারণ জনগণ না হন সেজন্য সেদেশে অবস্থানরতদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেশি দেশগুলোও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। প্রতিবেশি দেশগুলো এ হামলা বিষয়ে জানিয়েছে নানা প্রতিক্রিয়া:
লেবানন
সিরিয়ায় সম্ভাব্য হামলা বিবেচনায় লেবাননের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। লেবানন সরকার মনে করছে রাজধানী বৈরুত থেকে দামেস্ক’র দূরত্ব মাত্র ৭০ কিলোমিটার হওয়ায় সিরিয়ায় যে কোনো হামলায় দামেস্কের সঙ্গে সঙ্গে বৈরুত-এ অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সিরিয়ার মতো বড় দেশের পাশে লেবাননের মতো আয়তনে ক্ষুদ্র প্রতিবেশী সিরিয়ার ওপর যে কোনো হামলার সরাসরি প্রভাব পড়বে। এদিকে, লেবাননের ডেমোক্রেটিক দলের নেতা তালাল আরসালান বলেন, দামেস্কের উপকণ্ঠে বাশার সরকার রাসায়নিক অস্ত্র হামলা চালিয়েছে এ মিথ্যাচার যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক হামলার চালানোর মিথ্যাচারেরই বহিঃপ্রকাশ।
ইসরাইল
ইসরাইল সরকার মনে করে, সিরিয়ায় হামলা হলে সিরিয়াও পাল্টা রাসায়নিক অস্ত্র হামলা চালাতে পারে। তাই, আগাম সতর্কতা হিসেবে দেশটির শহরগুলোতে রাসায়নিক গ্যাসরোধী মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বার্তাসংস্থা সিএনএন-কে বলেন, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে ইসরাইল প্রস্তুত। তেলআবিব আক্রান্ত হলে আমি দামেস্ক-এ হামলা চালাব।
জর্ডান
সিরিয়ার সীমান্ত থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থান জর্ডানের। এমনকি, সিরিয়ার সব ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকির মুখে জর্ডানের সবকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। তার ওপর জর্ডানের রাজা কিং আবদুল্লাহ পশ্চিমা-বিশ্বের ঘনিষ্ঠ মিত্র। আরব নেতাদের মধ্যে কিং আবদুল্লাহই সর্বপ্রথম বাশারকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জর্ডানের বাশার বিরোধীদের সমর্থন দেয়ায় সিরিয়া জর্ডানে হামলা চালাতে পারে। কারণ জর্ডানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সুন্নী এবং তারা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
এটা এখন প্রমাণিত সত্য যে, সৌদি আরব জর্ডানের মাধ্যমে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ করে থাকে। তবে জর্দান বার বার বলছে তারা সিরিয়া যুদ্ধে জড়াতে চায় না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। গত সপ্তাহে সিরিয়ায় হামলা বিষয় নিয়ে বিশ্বের যুদ্ধবাজ দেশগুলোর নেতারা এই জর্ডানেই মিলিত হয়েছিলেন। তবে দেশটির সরকার বলছে তারা প্রতিবেশী দেশে পশ্চিমা হামলার ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হবে না।
এ বিষয়ে সরকারের মুখপাত্র মোহাম্মদ মোমেনি বলেন, ‘আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। আমরা কেবল আমাদের দেশের স্বার্থ নিয়ে চিন্তিত। অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমরা নাক গলাতে চাই না।’
ইরাক
আগস্ট মাসের শেষ দিকে গত পাঁচ দিনে কমপক্ষে ৩০ হাজার সিরীয় শরণার্থী ইরাকে আশ্রয় নিয়েছে। সম্ভাব্য মার্কিন হামলাকে কেন্দ্র করে ইরাকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা জারি করা হয়েছে। সিরিয়ায় মার্কিন হামলার বিরোধিতা করছে ইরাক। তাদের আশংকা এই হামলার ফলে প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত সুন্নী বিদ্রোহীরা বাগদাদ সরকারকে টার্গেট করবে। বাগদাদের শিয়া প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে সুন্নী বিক্ষোভ মোকাবেলা করছেন।
সৌদি আরব
মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নী অধ্যুষিত দেশ সৌদি আরব সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহীদের প্রধান সমর্থক। আর এ কারণে তারা সিরিয়ায় মার্কিন হামলারও অন্যতম সমর্থক। তবে সৌদি সরকার এখন অবদি সিরিয়ায় সামরিক অভিযানে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়নি। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সউদ আল ফয়সাল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি সিরীয় জনগণের দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বিদ্রোহীদের সমর্থন করে এবং তারা আসাদ সরকারের পতন চায়। তবে তাদের ধারণা মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সিরীয় জনগণের দুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি করবে।
ইয়েমেন
সিরিয়ায় মার্কিন হামলা নিয়ে ইয়েমেনে আতংক বিরাজ করছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের প্রতি তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও দেশটিতে এমন একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে যে হামলাকে সমর্থন করে। ইয়েমেনের হাক পার্টির নেতা আহমদ বাহরি সিএনএনকে বলেন, ‘ আরবরা যুক্তরাষ্ট্রকে আর বিশ্বাস করে না। কেননা তারা অনবরত আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে। দুঃখের বিষয় কিছু আরব নেতা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে পশ্চিমাদের পক্ষে কাজ করছে।’
মিসর
সমস্যায় আবর্তিত মিসর সিরিয়ায় সামরিক হামলার বিরুদ্ধে। দেশটির তামারুদ আন্দোলনের মুখপাত্র মাহমুদ বদর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ। এর আগে তারা ইরাক ধ্বংস করেছে। এখন সিরিয়াকে ধ্বংস করতে চাইছে। তারা মিসরের আভ্যন্তরীণ বিষয়েও নাক গলাচ্ছে।’ অন্য মুখপাত্র হাসান শাহিন সুয়েজ খাল বন্ধ করে দেয়ার দাবি করেন।
শেষ কথা
এমন একটা পরিস্থিতিতে সিরিয়ায় মার্কিন হামলাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী হামলা হিসেবেই মনে করছে। কারণ যুদ্ধ কখনও শান্তি বয়ে আনতে পারে না। শান্তির জন্য আলোচনার পথ সব সময় অবারিত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিশ্বের সব শান্তিপ্রিয় দেশই সিরিয়া পরিস্থিতি একমাত্র আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করার পক্ষে। কেও আর নতুন করে কোন ইরাকের জন্ম হোক তা চান না। সবাই আশাবাদি এখনও সময় রয়েছে মার্কিন প্রশাসন সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলা না চালিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনে এগিয়ে আসবেন। তথ্যসূত্র: বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার।