দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বর্তমান বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যেমন বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে সন্তান যত্নের শংকাও। তাই কর্মজীবী মায়েরা কিছু বিষয় মাথায় রাখলেই সন্তানের কাছে প্রিয় মা হয়ে উঠতে পারেন।
বাংলাদেশে প্রতিবছরই বাড়ছে কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র শিক্ষা, স্বাস’্য, উৎপাদন, ব্যবসা – বাণিজ্য এবং ব্যাংক ও বীমা সেক্টরে নারীর সংখ্যা বেড়েছে ২৫.১ শতাংশ (বিবিএস, এলএফএস)। নারীর এই অংশগ্রহনের মাত্রা আমাদের অর্থনীনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়াচ্ছে, সেই সাথে বাড়াচ্ছে সমাজে নারীর মর্যাদাও। কিন্তু প্রিয় সন্তানের কাছে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন কর্মজীবী মায়েরাই, বাড়ছে মা-সন্তান সম্পর্কের জটিলতা।
রাতে ঘুমাতে যাবার আগেই চিন্তা করতে হয় সকালে অফিস যাওয়ার আগে কী রান্না করা হবে, সন্তানদের কী খেতে দিতে হবে ইত্যাদি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নি:শ্বাস ফেলারও সময় থাকে না। এরপর অফিসে কাজের চাপ, অফিসের জটিলতা, ক্যারিয়ার – এসবতো আছেই, যা একজন কর্মজীবী নারীকে উদ্বিগ্ন করে রাখে। শত ব্যস্ততা ও উদ্বিগ্নতার মধ্যেও দেখা দেয় চিন্তা, ”বাড়িতে যাকে রেখে আসলাম সে ভালো আছে তো? কী করছে এখন বাবুটা?” এদিকে বাড়িতে থাকা মানুষটাও কী কম চিন্তায় থাকে? কম্পিউটার, টিভি, গেমস্ কতক্ষণ ভুলিয়ে রাখতে পারে তাকে? প্রতিটি কলিংবেল বা দরজায় টোকা, পায়ের শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে সে, ”এই বুঝি মা এল!!!!” বহুপ্রতীক্ষার পর যখন মা আসে যেন সবকিছু হাতের মুঠোয়, কী ভীষণ শক্তি আর সাহস জাগে, বেড়ে যায় দুষ্টুমিও। সারাদিন অফিসের নানান ঝামেলায় ক্লান্ত শরীরে সন্তানের দুষ্টুমি আর আবদার বিষম লাগে কখনও কখনও এবং তখনই বাঁধে বিপত্তির। এদিকে মাকে কাছে পাবার আকুলতা এবং নিজের মত করে কাছে না পাওয়াটা সন্তানের মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে, যেটি দিন দিন মা ও সন্তানের মাঝে দূরত্ব তৈরি করতে পারে।
এই দূরত্ব কমানোর জন্য মা’কেই প্রধান ভূমিকাগুলো নিতে হবে। নিচে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হল:
- মাঝে মাঝে আপনার সন্তানকে অফিসে নিয়ে যান। তাকে পুরো অফিসটা ঘুরিয়ে দেখান। অফিসের কলিগদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তাকে বুঝান আপনার অফিসেও তার গুরুত্ব অনেক। এতে আপনার সন্তান খুশী হবে এবং এর রেশ তার মনে অনেকদিন থাকবে।
- ছুটির দিনগুলো সম্পূর্ণ সন্তানকে দিন। পরিবারের সবাই মিলে ছুটির দিনে ঘুরতে বের হন। বাইরে খেতে পারেন আর যদি বের হওয়া সম্ভব না হয় তবে সন্তানের পছন্দসই মজার খাবার তৈরি করুন, তার গল্প শুনুন, তার সাথে খেলা করুন, ভুলেও ঐ দিন তার কোন দুষ্টুমিতে মাত্রাতিরিক্ত বকাঝকা করতে যাবেন না, বরং তাকে বুঝিয়ে বলুন। অনেক কর্মজীবী মায়েরা ছুটির দিনে সন্তানকে কড়া নজরদারিতে রাখেন। এমনকি সন্তানকে তার বন্ধুদের সাথেও খেলতে যেতে দেন না। সারাক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকতে বলেন। সপ্তাহের এইদিনের জন্য সমস্ত শাষণ তুলে রাখেন এবং ভাবেন এটাই মঙ্গল। আপনার এই ভুল ভাবনাই আপনাকে আপনার সন্তান থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। তাই এ ভাবনা এখনই পরিহার করুন।
- সন্তানের সামনে কখনও স্বামী – স্ত্রীর ঝগড়া করবেন না। এতে মানষিকভাবে সে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং অপরাধ প্রবণতা বাড়বে।
- আপনার সন্তানকে দেখাশুনার জন্য যাকে রেখেছেন কখনওই তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করবেন না। সন্তানের সামনেতো নাই। তাকে আপনার সন্তানের সবচে’ ভাল বন্ধু বানাতে সাহায্য করুন। আপনি তার সাথে খারাপ আচরণ করলে আপনার অবর্তমানে সেও আপনার সন্তানের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে।
- অফিস থেকে আসতে যদি কোন কারণে দেরি হয়ে থাকে তবে তাকে আগেভাগেই জানান। পারলে সম্ভাব্য সময় বলে দিন এবং কী কারণে দেরি হচ্ছে তাও তাকে জানানো উচিৎ।
- কোন কোন দিন ইচ্ছাকৃত ছুটি নেন। সেদিন তাকেও বলেন স্কুলে যেতে হবে না। সারাদিন আমরা গল্প করব। দেখবেন অনাকাঙ্খিত ছুটিতে আপনি তার কত ভাল বন্ধু হয়ে ওঠেন।
- সন্তানের সামনে কখনওই আপনার কোন আত্মীয় স্বজনের দুর্নাম করবেন না। বরং তাদের ভাল দিকগুলো তুলে ধরুন।
- সন্তানের শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। সশরীরে না পারলেও স্কুলের শিক্ষকদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করুন।
- যাদের বাসায় কিশোর/ কিশোরী আছে সেইসব কর্মজীবী মায়েদের সন্তানের সাথে আচরণে আরও বেশী সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এই বয়সে শারীরীক ও মানষিক পরিবর্তনের কারণে তার আচার আচরণও বদলে যায়। যে সন্তান কখনও মাথা তুলে দাড়ায় না, সেও মুখে মুখে তর্ক করে। অধিকাংশ কিশোর/ কিশোরীদের একটাই অভিযোগ, ’মা আমাকে বোঝার চেষ্টা করে না। শুধু শাষনই করে।’ তাই তাদের পরিবর্তনগুলো বোঝার চেষ্টা করেন। তাকে আশ্বস্ত করেন আপনি তার সবচে’ ভাল ও বিশ্বস্ত বন্ধু। তাদের স্কুলের গল্প এমনকি তাদের প্রেমের প্রস্তাবের গল্পও আপনি শোনেন। তারপর রাগারাগি না করে তাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেন। তার বয়সে আপনি কেমন ছিলেন আর তাই এখন আপনি কোন পর্যায়ে এসেছেন, তা বুঝিয়ে বলেন। এই বয়সে কখনওই আপনার সন্তানকে, ’বেয়াদপ’, ’অভদ্র’, ইত্যাদি গাল দিবেন না এবং অমকের মেয়ে বা তমকের ছেলে এই করে সেই করে এমন তুলনা দিবেন না। সে অন্যায় করলে তাকে তার ভাল দিকগুলো তুলে ধরে খারাপ দিকগুলোকে পৃথক করে দেখান। এতে সে শোধরাতে চাইবে।
- কর্মজীবী মায়েদের সন্তানের প্রতি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব হল সন্তানের হাতে বই তুলে দেওয়া। তার সঙ্গে বইয়ের একটা ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলা। কম্পিউটার গেমস বা কার্টুন থেকে এটা হবে তার সবচে’ ভাল বন্ধু। এবং তার পড়া বইটা নিয়ে দুজনে আলোচনা করতে পারেন।
বর্তমান প্রতিযোগীতাপূর্ণ যুগে টিকে থাকতে মাকে তার সন্তান রেখে যেতে হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে। অনেক বাঁধা বিপত্তি পার করে মা যখন সন্তানকে সাফল্যের চূড়ায় দেখতে পায় তখন সেই মা ধন্য। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা লিমা হকের মতে, ”সমাজ যেসব কারণে টিকে থাকে তা হল মিথস্ক্রিয়া, সহনশীলতা, ঐক্যমত্য, সততা, ভালোবাসা আর এ সব গুনই সন্তান পায় তার মায়ের কাছ থেকে।”