দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ চোরাবালির কথা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। কিন্তু এই চোরাবালির খপ্পড়ে যারা পড়েছেন কেবল তারাই জানেন এটি কতটা ভয়ংকর।
চোরাবালি আসলে কি
সাধারণতভাবে আমরা চোরাবালি বলতে বুঝি- যখন বালি, কাদা বা নুড়ি গর্ভস্থ পানির প্রবাহের সান্নিধ্যে আসে, সেই বালি বা নুড়ির দানাগুলোর মধ্যে যে ঘর্ষণ শক্তি থাকে তা কম হয়ে যায়, আর সেই বালি বা মাটি ভার সহ্য করতে পারে না- একেই চোরাবালি বলে। এ ধরনের ব্যাপার আমরা সমুদ্র সৈকতে দেখতে পাই। সমুদ্রধারের বালিতে যদি কেও দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে খানিকক্ষণ পর দেখা যাবে যে ধীরে ধীরে তার পা বালির ভেতর বসে যাচ্ছে। এটাও এক ধরনের ছোটখাটো চোরাবালি। তবে এ ধরনের চোরাবালির গভীরতা মাত্র কয়েক ইঞ্চি হয়। তাই সেসব স্থানে শুধু আমাদের পায়ের পাতা ডোবে। তবে যে সব স্থানে এর গভীরতা বেশি সেসব স্থান খুবই ভয়ংকর।
চোরাবালি পানি ও তরল কাদা মিশ্রিত এমনই একটি গর্ত, এর ফাঁদে একবার পা দিলে আর নিস্তার নেই। আস্তে আস্তে ডুবে যেতে হয় বালির ভেতর। যত নড়া যায় ততই ডুবে যেতে থাকে শরীর। সাধারণত নদী বা সমুদ্রতীরে কাদা মিশ্রিত বালির ভেতরে লুকানো অবস্থায় থাকে চোরাবালি। কোনও মানুষ যদি সেই গর্তের ধারে-কাছে যায়, তাহলে শরীরের চাপে ওই বালি ক্রমে সরে যেতে থাকে। ফলে মানুষ শত চেষ্টা করেও আর ওপরে উঠে আসতে পারে না। চোরাবালিতে পড়ার পর সেখান থেকে উঠে আসার জন্য চেষ্টা করলে শরীরের চাপে আরও দ্রুত ডুবে যেতে হয়। সময়মতো কেও এগিয়ে না এলে ওই মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ে। তবে অধিকাংশ চোরাবালি সাধারণত মারাত্মক নয়। তবে এটি প্রকৃতির একটি অদ্ভুত বিস্ময়।
কোথায় চোরাবালি বেশি হয়
সাধারণত মাটি বা বালির ভার সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না। প্রবহমান পানির কারণে বালি বা মাটির দানাগুলোর মধ্যে ঘর্ষণ একদম কমে যায়। পুরো জায়গা বেশ গভীর স্তর পর্যন্ত একরকম তরল অবস্থায় চলে যায়। এ ধরনের চোরাবালির গভীরতা যদি কয়েক মিটার বা বেশি হয় তাহলে তা বিপজ্জনক। এ ধরনের চোরাবালিতে ফেঁসে গেলে বেরিয়ে আসা খুব মুশকিল। হাত-পা বালিতে আটকে যেতে পারে। নিজে থেকে বেরিয়ে আসাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। পুরোপুরি ডুবে যেতে পারে। অনেক সময় এ ধরনের চোরাবালির গভীরতা বেশি না হলে মানুষ পুরো ডুবে না গেলেও অর্ধেক ডুবে আটকে যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিও কিন্তু কম বিপজ্জনক নয়। পুরো না ডুবলেও ঠাণ্ডা, ভয় বা ক্ষুধাজনিত কারণেও অনেক সময় মৃত্যু হতে পারে। চোরাবালিতে আটকে গিয়ে বেরুতে না পেরে জীব-জন্তু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অনেক লোকের মৃত্যু হয়েছে এমন ঘটনাও কিন্তু বিরল নয়। তাই যেসব জায়গায় চোরাবালি থাকার সম্ভাবনা আছে, সেসব জায়গায় একা একা বেড়াতে যাওয়া মোটেও উচিত নয়। যেসব জায়গায় পানি বেশি, সেসব জায়গায় চোরাবালি থাকার সম্ভাবনাও বেশি। যেমন জলা, নদী, খাল, সমুদ্রতীর এবং জলাভূমি। যেসব জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ থাকে সেখানে চোরাবালি থাকতে পারে বা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
চোরাবালিতে আটকে গেলে যা করতে হবে
চোরাবালিতে আটকে গেলে একদমই অধৈর্য হওয়া যাবে না। অধৈর্য হয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করলে আরও বেশি আটকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সবার মনে রাখা উচিত, চোরাবালি কিন্তু পানির চেয়ে অনেক বেশি ঘন। তাই চোরাবালিতে ভেসে থাকা পানির চেয়ে অনেক বেশি সহজ। যদি সঙ্গে কোনও ভারি বস্তু থাকে তাহলে তা ছেড়ে ফেলতে হবে। কারণ ভারি বস্তু আরও বেশি দ্রুত নিচে টেনে নিতে পারে।
বেশিরভাগ চোরাবালির গভীরতা কম হয়। খানিকটা ডোবার পর হয়তো পা তলায় আটকে যেতে পারে। যদি তা না হয়, মানে যদি চোরাবালি খুব গভীর হয় তাহলে পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে যেমন পানিতে আমরা যেভাবে সাঁতার কাটি, ঠিক সেভাবে নিজের শরীরকে যতটা সম্ভব অনুভূমিক করে ফেলতে হবে। তারপর খুব ধীরে ধীরে সাঁতরে চোরাবালির বাইরে আসার চেষ্টা করতে হবে। সাথে যদি অন্য কোনও ব্যক্তি থাকে তাহলে তাকে বলতে হবে নিরাপদ দূরত্ব থেকে রশি ফেলতে এবং এই রশি ধরে ধীরে ধীরে চোরাবালি থেকে উঠে আসা যাবে।
চোরাবালির আদি ইতিহাস
চোরাবালি ভূবিদ্যায় অনেক অবদান রেখেছে। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই পৃথিবীতে চোরাবালি আছে। সেই সময় যেসব জীবজন্তু চোরাবালিতে আটকা পড়ে মারা গিয়েছিল তাদের দেহবাশেষ মাটিতে পচে ফসিলে পরিণত হয়েছে। হলিউডের বিখ্যাত ‘জুরাসিক পার্ক’ বা ‘কিং কং’ সিনেমায় ডাইনোসরদের দেখানো হয়েছে। এসব ডাইনোসর বা অন্য জন্তুজানোয়ারদের কথা আমরা বর্তমান সময়ে এসে জানতে পেরেছি তাদের জীবাশ্ম থেকে। আর এসব জীবাশ্ম আমরা পেয়েছি সেই সময়কার পাথর থেকে। আসলে চোরাবালিতে আটকে গিয়ে এসব জীবজন্তু মাটির তলায় তলিয়ে গিয়েছিল। মাটির ভেতরে আটকে যাওয়ার দরুন, তাদের দেহবাশেষ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। এই চোরাবালি কয়েক লক্ষ বছর পরে ধীরে ধীরে পাথরে পরিণত হয়।
যেসব জায়গায় পানি বেশি, সেসব জায়গায় চোরাবালি থাকার সম্ভাবনাও বেশি। যেমন জলা, নদী, খাল, সমুদ্রতীর এবং জলাভূমি। আবার যেসব জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ থাকে সেখানে চোরাবালি থাকতে পারে। চোরাবালি কোথায় আছে সেটা জানতে পারা খুব মুশকিল। অনেক সময় চোরাবালির ওপর শুকনো পাতা, ডালপালা পড়ে জায়গাটি ঢেকে থাকে। অনেক সময় চোরাবালির ওপর শুকনো বালির স্তর পড়ে যায়, যাতে বোঝা যায় না যে তার তলায় চোরাবালি আছে। চোরাবালি অনেক সময় পানির তলাতেও থাকতে পারে। হেঁটে নদী পার হওয়ার সময় চোরাবালিতে আটকে গিয়ে মৃত্যুও হতে পারে। সূত্র: অনলাইন।