দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিএনপি নেতা সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত।
আজ মঙ্গলবার বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় প্রদান করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সাকা চৌধুরীর মামলায় উভয়পক্ষের শুনানি ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ১৪ আগস্ট থেকে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছিলেন। আজ সেই প্রতীক্ষিত রায় প্রদান করলেন।
মামলাটির শুনানিতে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সাকা চৌধুরীর সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করা হয়। গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুট, দেশান্তরে বাধ্য করাসহ ২৩টি অপরাধের মধ্য ১৭টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাক্ষ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করেছে প্রসিকিউশন।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত ৯ অভিযোগ
ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯টি প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। তবে ১ নম্বর এবং ১০, ১১, ১২, ১৪, ১৯, ২০ ও ২৩ অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এছাড়া ৯, ১৩, ১৫, ১৬, ২১ ও ২২ নম্বর অভিযোগের বিষয়ে কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি।
প্রমাণিত অভিযোগগুলো হলো
অভিযোগ-২
১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যরা গহিরা গ্রামে হিন্দু অধ্যুষিত পাড়ায় অভিযান চালিয়ে হিন্দুদের ডাক্তার মাখন লাল শর্মার বাড়িতে জড়ো করা হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
অভিযোগ-৩
১৩ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা গহিরা শ্রী কু-শ্েবরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে ব্রাশফায়ার করে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজে তাকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
অভিযোগ-৪
১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত জগত্মলস্নপাড়ায় অভিযান চালান। এ সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দুই সহযোগীর আহবানে সেখানকার হিন্দু নর-নারীরা কিরণ বিকাশ চৌধুরীর বাড়ির আঙিনায় জড়ো হয়। সেখানে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে ৩২ নারী-পুরুষ মারা যান।
অভিযোগ-৫
১৩ এপ্রিল বেলা একটার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার অনুসারীদের নিয়ে চট্টগ্রাম জেলার রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে হামলা চালান। সেনা সদস্যরা বণিকপাড়ায় প্রবেশ করে ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে অভিযান চালিয়ে নেপাল চন্দ্র ধর, মনীন্দ্র লাল ধর, উপেন্দ্র লাল ধর ও অনিল বরণ ধরকে গুলি করে। এতে প্রথম ৩ জন শহীদ ও শেষের জন আহত হন। হত্যাকা- শেষে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী তাদের অনুসারী ও পাকিস্তানি সৈন্যদের সুলতানপুর গ্রাম ত্যাগ করেন।
অভিযোগ-৬
১৩ এপ্রিল বিকেল ৪টায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ক্ষিতীশ মহাজনের বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে শান্তি মিটিংয়ের নামে হিন্দু নর-নারীদের একত্রিত করে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রাশফায়ারে হত্যা করে।
অভিযোগ-৭
১৪ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাউজান পৌরসভার সতীশ চন্দ্র পালিতের বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং তার লাশ কাঁথাকাপড় দিয়ে মুড়িয়ে তাতে পাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলে।
অভিযোগ-৮
১৭ এপ্রিল সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরসহ তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য প্রাইভেটকারযোগে চট্টগ্রামের রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসছিলেন। পথে হাটহাজারী থানার খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি তিন রাস্তার মোড়ে পৌঁছামাত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা শেখ মোজাফফর আহম্মেদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে স্থানীয় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
অভিযোগ-১৭
৫ জুলাই সন্ধ্যা রাতে চট্টগ্রাম জেলার কোতোয়ালি থানার হাজারী লেনের জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পোড়োবাড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গুডসহিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মেজর গজনফরের নেতৃত্বে ঘণ্টা দেড়েক তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। পরে ওইদিন রাত ১১ থেকে ১২টায় নিজাম উদ্দিন ও সিরাজকে চট্টগ্রাম কারাগারে নিয়ে গিয়ে কারারুদ্ধ করা হয়। সেখানে তারা দেশ স্বাধীন হওয়ায় আগ পর্যন্ত বন্দী ছিলেন।
অভিযোগ-১৮
জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা চট্টগ্রাম জেলার চান্দগাঁও থানার মোহারা গ্রামে আব্দুল মোতালেব চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে তারা সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করেন। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়িতে নিয়ে তাকে গুডসহিলে টর্চার সেলে নেওয়া হয়। বাড়ির বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে থাকা সাকা চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় সালেহউদ্দিনকে উদ্দেশ করে ফজলুল কাদের চৌধুরী জানতে চান, তিনি সালেহউদ্দিন কিনা। এ কথা বলতে বলতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে সালেহউদ্দিনের বাম গালে সজোরে একটি চড় মারেন।
প্রমাণিত হয়নি
অভিযোগ-১
১৯৭১ সালের ৪ বা ৫ এপ্রিল রাত ৯টার পর মতিলাল চৌধুরী, অরুণ চৌধুরী, যোগেশ চন্দ্র দে, পরিতোষ দাসরা একত্রিত হয় শহীদ মতিলাল চৌধুরীর চট্টগ্রাম শহরের রামজন লেনের বাসভবনে। সেখান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যের সহায়তায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী সোবহান ছয়জনকে অপহরণ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাসভবন গুডসহিলে নিয়ে যান। সেই ৬ ব্যক্তির আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। যা থেকে নিশ্চিত ধরে নেওয়া যায় যে, তাদের সেখানেই হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-১০
১৩ এপ্রিল পাকিস্তানিরা সাকা চৌধুরীর সঙ্গে ডাবুয়া গ্রামে মানিক ধরের বাড়িতে এসে তার জিপ গাড়ি ও ধান ভাঙ্গার কল লুট করে নিয়ে যায়। মানিক ধর সাকা চৌধুরীসহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
অভিযোগ-১১
২০ এপ্রিল সকালবেলা কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে তাদের অনুসারী এবং পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী থানার হিন্দু অধ্যুষিত শাকপুরা গ্রামে অভিযান চালিয়ে হিন্দুদের হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-১২
৫ মে সকাল সাড়ে ১০টায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাউজান থানার জ্যোতিমলস্ন গ্রামে গুলি করে বিজয় কৃষ্ণ চৌধুরী রাখাল, বিভূতি ভূষণ চৌধুরী, হীরেন্দ্র লাল চৌধুরীকে হত্যা করে।
অভিযোগ-১৪
২০ মে বিকেল ৪টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার পথেরহাটের কর্তার দীঘির পাড়ে হানিফকে আটক করে গুডসহিল নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে এক হাজার টাকা মুক্তিপণ দিতে না কারণে হানিফকে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-১৯
২৭ জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে আটটায় হাটহাজারীর নেয়ামত আলী রোডের সাহেব মিয়ার বাড়ি (রজমান টেন্ডলের বাড়ি) ঘেরাও করে তার দু’ছেলে নুর মোহাম্মদ ও নুরুল আলমকে অপহরণ করা হয়। এরপর রশি দিয়ে বেঁধে গুডসহিলে টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের অপর ভাই মাহবুব আলমের সন্ধান পান। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নুর মোহাম্মদ ও নুরুল আলমকে ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে গুডসহিলের নির্যাতন কেন্দ্রে থেকে ছেড়ে দেন।
অভিযোগ-২০
২৭ অথবা ২৮ জুলাই বিকেল ৩ থেকে ৪টায় রাজাকারবাহিনী আকলাচ মিয়াকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাকে গুডসহিলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। সেখানে তার মৃত্যু ঘটে।
অভিযোগ-২৩
২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক সোয়া ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মুসলিম ছাত্র পরিষদের সভাপতি ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের আলশামস কমান্ডার হামিদুল কবির চৌধুরী খোকা, মাহবুব, সৈয়দ ওয়াহিদুর আলম গং চট্টগ্রাম জেলার কোতোয়ালি থানার ৪০ আব্দুস সাত্তার রোড এলাকার এম সলিমুল্লাহর একজন হিন্দু কর্মচারীকে মিথ্যা এবং বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে মারধর করতে থাকেন। তাদের অভিযোগ হলো ওই হিন্দু কর্মচারী বিহারিদের ঘরে অগ্নিসংযোগ করেছেন। এম সলিমুলস্নাহ এতে বাধা দিলে তাকে গুডসহিলে নির্যাতন সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সারারাত নির্যাতন শেষে তার আত্মীয়দের অনুরোধে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
মূল্যায়ন হয়নি
অভিযোগ-৯
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালীতে আসেন। একটি জিপে করে আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী একই সঙ্গে চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী থানার সিও অফিসস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে আসেন। বোয়ালখালী থানার কদুরখিল গ্রামে যাওয়ার সময় মুন্সীরহাটের শান্তি দেবকে ধরে নিয়ে আসে। তাকে থানার উত্তর পাশে বণিকপাড়ায় গুলি করে হত্যা করে। অনতিদূরে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তখন ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন।
অভিযোগ-১৩
১৫ মে সন্ধ্যার সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে শান্তি কমিটির সদস্য অলি আহম্মদ পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে ঘাসিমাঝির পার এলাকায় আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়িঘরে আক্রমণ করে লুটপাট, ৬ জনকে গুলি করে হত্যা, ২ জনকে গুরুতর আহত এবং অন্তত ৫ মহিলাকে ধর্ষণ করে। নিহতরা হলেন- নুরুল আলম, আবুল কালাম, জানে আলম, মিয়া খাঁ, আয়েশা খাতুন ও সালেহ জহুর।
অভিযোগ-১৫
মে মাসের মাঝামাঝিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা শেখ মায়মুন আলী চৌধুরীকে আটক করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গুডসহিল নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর নির্দেশে পরনের জাঙ্গিয়া ছাড়া সকল কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে হাত-পা বেঁধে তাকে দৈহিক নির্যাতন করা হয়।
অভিযোগ-১৬
৭ জুন জামাল খান রোড থেকে ওমর ফারুককে ধরে নিয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীন গুডসহিলের চর্টার সেলে রাখা হয়। পরবর্তীতে তাকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-২১
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ৫ অথবা ৭ তারিখের দিকে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার বিনাজুরি গ্রামের ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল হক চৌধুরী একই জেলার কোতোয়ালি থানার জেল রোডে অবস্থিত নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাগজের দোকানে যান। সেখান থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে অপহরণ করে গুডসহিলে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ৩ থেকে ৪ দিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।
অভিযোগ-২২
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দিকে এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন রাত আনুমানিক ৯টায় মো. নুরুল আনোয়ার চৌধুরীকে অপহরণ করা হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার সহযোগী আলশামস বাহিনীর সদস্যরা মৃত আশরাফ আব্দুল হাকিম চৌধুরীর বাসভবন ৪১/২ স্ট্যান্ড রোড সদরঘাট, থানা ডবলমুরিং জেলা চট্টগ্রাম থেকে তাকে অপহরণ করে গুডসহিলে নিয়ে যান। সেখানে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী মো. নুরুল আনোয়ারের কাছ থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করেন।
উল্লেখ্য, বিএনপি নেতা সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। ওই বছরের ১৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিক এ অভিযোগ আমলে নিয়ে ২৩টি অভিযোগে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ২০১২ সালের ১৪ মে প্রসিকিউশনের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে গত ২৮ জুলাই তা শেষ হয়। প্রসিকিউশনের ৪১ জন এবং আসামিপক্ষে চার জনের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়।
মামলার ইতিহাস
২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) জমা দেওয়া হয়। ১৮ নভেম্বর এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ৫৫ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগের সঙ্গে এক হাজার ২৭৫ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক নথিপত্র এবং ১৮টি সিডি ট্রাইব্যুনালে জমা দেয় প্রসিকিউশন। তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৫টি অভিযোগ উত্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ট্রাইব্যুনাল ২৩টি অভিযোগ গঠন করেন। এসব অভিযোগের মধ্যে আছে ছয়টির বেশি গণহত্যাসহ তিন শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা, পাঁচজনকে ধর্ষণে সহযোগিতা, লুট, নির্যাতন ইত্যাদি। সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি) এবং ৩(২)(এইচ) ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়।
২০১২ সালের ৪ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে সাকার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। গত বছরের ৩ মে ও ৭ মে প্রসিকিউশন সূচনা বক্তব্য দেয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ১৪ মে। এ বছর ১৩ জুন পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। তাঁর বিরুদ্ধে ৪১ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। এ ছাড়াও চারজন সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন তা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। সাকা নিজে এবং আরো তিনজন সাক্ষী তাঁর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন। গত ২৭ জুন থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত সাফাই সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেন ট্রাইব্যুনাল।
এ বছর ২৮ জুলাই এ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু হয়। ৩১ জুলাই পর্যন্ত চার কার্যদিবস রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করে। গত ১ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত সাকার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন তাঁর আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসানুল হক হেনা ও ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম। এরপর আবার আইনগত বিষয়ে আসামি পক্ষের যুক্তি খণ্ডন করে বক্তব্য দেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, জেয়াদ আল মালুম ও সুলতান মাহমুদ।
যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন
সাকা চৌধুরীর মামলায় যাঁরা সাক্ষ্য দেন তাঁর হলেনথবিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সলিমুল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সিরু বাঙালি, শহীদ নুতন চন্দ্র সিংহের ছেলে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ ও ভাতিজা গৌরাঙ্গ সিংহ, শহীদজায়া বাসন্তি ঘোষ, শহীদপুত্র পরিতোষ কুমার পালিত, মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট নির্মল চন্দ্র শর্মা, আব্বাস উদ্দিন আহম্মেদ (আব্বাস চেয়ারম্যান), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. সালেহ উদ্দিন, ব্যবসায়ী পরাগ ধর (ক্যামেরা ট্রায়াল), সাবেক ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধা কাজী নূরুল আফসার, মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম, অরুণাংশু বিমল চৌধুরী ও তাঁর ভাতিজা আশীষ চৌধুরী, অধ্যক্ষ গোপাল চন্দ্র দাশ, সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমদ, ফয়েজ আহমেদ সিদ্দিকী, একজন ক্ষতিগ্রস্ত নারী (ক্যামেরা ট্রায়াল), দেবব্রত সরকার, মুক্তিযোদ্ধা ও সংগীত শিল্পী সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম জুনু, শেখ মোরশেদ আনোয়ার, মুক্তিযোদ্ধা আবুল বশর, অনীল বরণ ধর, মুক্তিযোদ্ধা বনগোপাল দাশ, বাবুল চক্রবর্তী বুলবুল, মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের চৌধুরী, মো. সোলায়মান, ডা. এ কে এম শফিউল্লাহ, সুবল চন্দ শর্মা, মো. নাজিম উদ্দিন, সুজিত মহাজন, মাহমুদ আলী, বিজয় কৃষ্ণ চৌধুরী, কামাল উদ্দিন এবং চপলা রানি। এসব ক্ষতিগ্রস্ত ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষ্যগ্রহণ ছাড়াও জব্দ করা বিভিন্ন দলিলের বিষয়ে চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এঁরা হলেন বাংলা একাডেমির সহকারী গ্রন্থাগারিক এজাব উদ্দিন মিয়া, চট্টগ্রামের রাউজান থানার এএসআই মো. এরশাদুল হক, এসআই মোলস্না আব্দুল হাই ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের বুক শর্টার কাওসার শেখ। এ ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জ্যোৎস্না পাল চৌধুরী, জানতি বালা চৌধুরী, আবুল বশর এবং বাদল বিশ্বাসের দেওয়া বক্তব্যকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। এঁদের মধ্যে প্রথম তিনজন এরই মধ্যে মারা গেছেন। অপরজন ভারতে রয়েছেন বলে ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
সাকা চৌধুরী নিজে সাফাই সাক্ষ্য দেন। এ ছাড়া তাঁর পক্ষে তাঁর কলেজজীবনের বন্ধু নিজাম আহমেদ, এশিয়া-প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য কাইয়ুম রেজা চৌধুরী ও সাবেক রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোমেন চৌধুরী সাক্ষ্য দেন।
বিএনপির প্রভাবশালী নেতা সাকা চৌধুরী
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করে দলের ভেতরে-বাইরে আলোচিত ও সমালোচিত হলেও সাকা চৌধুরী বিএনপির প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি বিএনপির নীতিনির্ধারকদের অন্যতম। নানা কারণে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। প্রধান বিরোধী দলের আরো যাঁরা বিচার ও তদন্তের আওতায় : সাকা চৌধুরী ছাড়াও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার চলছে বিএনপির সাবেক নেতা জিয়াউর রহমানের আমলের মন্ত্রী আবদুল আলীমের। তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ। এ ছাড়া ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন রাজাকারের বিচারও চলছে ট্রাইব্যুনালে। সাকা চৌধুরীর ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর (গিকা চৌধুরী) বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তদন্ত করছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা বলে জানা গেছে।