বিদায়বেলায় স্বরূপে ফিরে একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকিয়ে টেন্ডুলকার করেছেন ৭৪ রান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের ঠিক দুই যুগ পূর্তির দিনটিতে ৭৪ রান করে বিদায় নেন ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল এই ব্যাটসম্যান।
ডিওনারায়ণের করা অফ স্ট্যাম্পের বাইরের একটি বল কাট করতে যাওয়ার আগে বলটি একটু লাফিয়ে উঠায় ঠিকভাবে খেলতে পারেননি টেন্ডুলকার। ব্যাটের কানায় লেগে বলটি স্লিপে অপেক্ষমান ড্যারেন স্যামি ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাচটি লুফে নিলে পুরো স্টেডিয়ামে নেমে আসে এক ধরনের শোকের ছায়া। মাঠ ছাড়ার সময় টেন্ডুলকারকেও খুব বিষণ্ন দেখাল। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেলো আবেগ ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন টেন্ডুলকারের মা রজনী টেন্ডুলকার। টেন্ডুলকার বেরিয়ে যাওয়ার সময় পর্দায় দেখা গেল তাঁর স্ত্রী অঞ্জলীকেও। তাঁর চোখে-মুখে ছিল বিষণ্নতার ছাপ।
টেন্ডুলকারের ১১৮ বলের ইনিংসে ১২টি চার। ব্যাটিং কিংবদন্তীর বিদায়ে ভাঙে চেতেশ্বর পুজারার সঙ্গে তার ১৪৪ রানের চমৎকার জুটি। চলতি বছর এটি টেন্ডুলকারের দ্বিতীয় টেস্ট অর্ধশতক। গত ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৮১ রান করার আট ইনিংস পর অর্ধশতক পেলেন বিদায়ী টেস্টে খেলা টেন্ডুলকার। এখন পর্যন্ত মুম্বাই টেস্টের যা অবস্থা, দ্বিতীয় টেস্টে ব্যাটিং করতে না-ও হতে পারে ভারতীয় দলের। সে ক্ষেত্রে ব্যাট হাতে টেন্ডুলকারকে আর দেখা যাবে না! কাকতালীয় ২৪ বছর আগে ঠিক এই দিনেই (১৯৮৯ সালের ১৫ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁর। সেদিন টেস্ট ক্যাপ পরেছিলেন টেন্ডুলকার।
১৯৮৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে টেস্ট ক্যাপ পরে দেশের জন্য খেলতে নেমেছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের লড়াকু দুনিয়া তাকে স্বাগতম জানিয়েছিল ওয়াকার ইউনুসের বাউন্সারে। পাকিস্তান দলের সাবেক কোচ ওয়াকার ইউনুসেরও অভিষেক ছিল সে ম্যাচে। পাকিস্তানী ভয়ঙ্কর পেস আক্রমনের মুখে প্রবল প্রতিরোধ গড়েও ওয়াকারের বলেই বোল্ড হয়েছিলেন তিনি, আউট হওয়ার আগে করেছিলেন মাত্র ১৬ রান। সিরিজের শেষ ম্যাচে ওয়াকার ইউনুসের বল আঘাত করেছিল তার মুখে, রক্তক্ষরণে ভিজে গিয়েছিল শার্ট, তবুও মাঠ ছাড়েননি। ঐ ওভারেই দুইবার বাউন্ডারির বাইরে বল পাঠিয়ে জবাব দিয়েছিলেন।
২০ ওভারের এক প্রদর্শনী ম্যাচে খেলেছিলেন ১৮ বলে ৫৩ রানের এক বিদ্ধংসী ইনিংস, সর্বকালের অন্যতম সেরা এবং তৎকালিন দুনিয়ার সেরা স্পিনার আবদুল কাদেরের ১ ওভারেই করেছিলেন ২৮ রান। প্রচন্ড জেদ আর বিদ্ধংসী ব্যাটিং দিয়েই দুনিয়াকে জানিয়েছিলেন নিজের আগমনি বার্তা। পরের বছর মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের মাঠে করেছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। তিনি আমাদের সময়কার নায়ক, ক্রিকেট দুনিয়ার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের একজন, শচীন টেন্ডুলকার।
এরপরের কাহিনী? শুধুই ইতিহাস। বয়স ২৫ না পেরুতেই ১৬টি টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক ছিলেন তিনি। ৯০এর দশক জুড়েই খুনে ব্যাটসম্যান এবং দ্বিতীয় ভিভ রিচার্ডস তকমা পাওয়া টেন্ডুলকার একবিংশ শতকের দ্বারপ্রান্তে এসে আরো দীর্ঘকাল ক্রিকেট খেলে যাওয়ার জেদের বশেই কি না, খুন করে ফেললেন নিজের ভেতরের ভিভ রিচার্ডসকে। জেদ, প্রতিভা আর ব্যাটিং সৌন্দর্যের যুবরাজ একই সাথে হয়ে গেলেন ধৈর্য্যের পরাকাষ্ঠা। ২০০০ সাল নাগাদ টেস্ট এবং ওয়ানডে মিলিয়ে ৫০টি সেঞ্চুরি করা প্রথম ব্যাটসম্যানে পরিণত হন।
এক কালে সাইদ আনোয়ারের সাথে সেঞ্চুরির প্রতিযোগীতা ছিল টেন্ডুলকারের, ব্যাটিং শ্রেষ্ঠত্বে প্রতিদ্বন্দিতা ছিল ব্রায়ান লারার সাথে। সাইদ এবং লারা এই প্রতিযোগীতা থেকে ছিটকে পড়েন অনেক আগেই, সম্ভাবনা জাগিয়েও সেঞ্চুরির শ্রেষ্ঠত্বের দুর্গে হানা দিতে পারেননি রিকি পন্টিং। ২০০৮ সালেই টেস্টে সর্বোচ্চ রান অর্জনকারীর খেতাবটা তিনি কেড়ে নেন ব্রায়ান লারার কাছ থেকে, ওয়ানডে ক্রিকেটেও তার চেয়ে বেশী রান কখনো করেনি কেউ।
৩৬ বছর বয়সে করেছেন ওয়ানডে ক্রিকেটের একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরি, ওয়ানডে ক্রিকেটের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটাও তার দখলে। টেস্ট ক্রিকেটের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা বাদে সর্বোচ্চ রানের আর সব রেকর্ডই তার দখলে। ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান তিনি নিঃসন্দেহে, কেউ কেউ আবার ডন ব্রাডম্যানের শ্রেষ্ঠত্বের মালাটাও টেন্ডুলকারকে দিতে কুন্ঠাবোধ করেন না। নিজের ২১ বছরের ক্রিকেটিং ক্যারিয়ারে সমসাময়িক সবাইকে ছাড়িয়েছেন তিনি, হয়েছেন জীবন্ত কিংবদন্তি, এমন এক উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গেছেন, আসন্ন টি২০ ক্রিকেট দুনিয়ায় সেই উচ্চতা হয়তো আর কারো ছোঁয়া হবে না।