ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ আসলে দেশে ৭১ এর স্বাধীনতায় কতজন মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তার কি কোন সঠিক ইতিহাস নেই? বার বার সরকার পরিবর্তন হয়েছে আর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যার পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
দেশ স্বাধীনের ৪০ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সঠিকভাবে কোন সরকারই করতে পারেনি। যে যখন ক্ষমতায় এসেছে, তখনই তাদের পছন্দমতো লোকদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কি আমরা কখনও পাবো না?
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েক বার এর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যেহেতু আওয়ামীলীগ সরকার এদেশ স্বাধীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটিতে জড়িত ছিল। তাই তাদের ওপর এর দায়িত্বটা বেশি বর্তায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ অনেক বারই মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে সভা করে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যা এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়নি।
জানা গেছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তকরণ এবং তালিকাভুক্ত অমুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই কার্যক্রম ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার তাগিদ দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। নিয়ম অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপজেলা কমান্ড, মহানগর কমান্ড, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তালিকা ও সুপারিশ বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে পাঠাতে হবে। এরপর সংসদের সুপারিশসহ এই তালিকা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠানো হবে। পরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করবে। ইতিমধ্যেই অধিকাংশ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হবে না বলে কেন্দ্রীয় সংসদকে জানিয়ে দিয়েছে। তারা বলেন, এজন্য তাদের আরও দুই মাস সময় দিতে হবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এ ব্যাপারে এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। এর ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও জটিলতা কাটেনি।
আওয়ামীলীগ তথা মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে জেলা প্রশাসক দিয়ে জেলা যাচাই-বাছাই কমিটি, উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের দিয়ে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি এবং প্রতিটি মহানগরের জেলা প্রশাসকদের দিয়ে মহানগর যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এই কমিটি গঠনের দুই বছরের মাথায় যাচাই-বাছাই সম্পর্কে কোন অগ্রগতি না হওয়ায় সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নির্ধারিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নেতাদের দিয়ে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি, জেলা পুনঃপরীক্ষা ও আপিল নিষ্পত্তি কমিটি, মহানগর যাচাই-বাছাই কমিটি, কেন্দ্রীয় পুনঃপরীক্ষা ও আপিল নিষ্পত্তি কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল এই কমিটি পুনর্গঠন করা হলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং অমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেয়ার আবেদনগুলো কেন্দ্রীয় সংসদ থেকে জেলা, উপজেলা এবং মহানগর যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে পাঠানো হয়। যাচাই-বাছাই করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে ছাপানো ফরম উপজেলা, জেলা ও মহানগরীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সংসদের পাঠানো এই তালিকা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়ায় সংসদ থেকে পাঠানো এক সার্কুলারে ’৯৬ সালের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের লাল বইয়ে ছাপানো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামগুলো সম্পর্কে কোন যাচাই-বাছাই না করার নির্দেশ দেয়া হয়। এই নির্দেশ পাওয়ার পর যাচাই-বাছাইয়ের কাজ আবার শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সংসদের ছাপানো ফরম পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা একটি নতুন ফরম তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠায় এবং ওই ফরম পূরণ করে যাচাই-বাছাই কাজ করার নির্দেশ দেয়। এই সিদ্ধান্তের আলোকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় চলতি বছরের ১৩ মে নতুন ফরম ছাপিয়ে জেলা, উপজেলা ও মহানগর কমান্ডে পাঠায়। বর্তমানে এই ফরম অনুযায়ী যাচাই-বাছাই কাজ চলছে। এ কারণে জেলা সংসদ থেকে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ আগামী দুই মাসে শেষ হবে না বলে সংসদকে জানানো হয়। যদিও সংসদের পক্ষ থেকে জেলা, উপজেলা এবং মহানগর কমান্ডের বাছাই কমিটিকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সংসদ কর্মশালার আয়োজন করে। ওই কর্মশালায় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ফরম ছিল সংসদের তৈরি করা ফরম। কিন্তু এখন ফরমের পরিবর্তন করায় নতুন করে কর্মশালা হবে কি না এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি।
জানা যায়, গেজেটে তিন পৃষ্ঠার ছাপানো এই ফরমে ‘ক’ অংশে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতি এবং ‘খ’ অংশে যুদ্ধবৃত্তান্ত সম্পর্ক তথ্য চাওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছাপানো সর্বশেষ গেজেট অনুযায়ী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ দুই হাজার ৯শ’ জন। কল্যাণ ট্রাস্টের যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এই তালিকার বাইরে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ৭ হাজার ১৩৬ জন রয়েছে। ১০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে দেড় লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানী ভাতা প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ৪৫ হাজার ৭৬৪ জন মুক্তিযোদ্ধা এখনও ভাতা পান না। অথচ অভিযোগ রয়েছে, ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ভারতে যায়নি কিংবা দেশেও প্রশিক্ষণ নেয়নি এমন অমুক্তিযোদ্ধারা বর্তমানে ভাতা পাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দিলেও দুই বছরে এখনও তালিকা প্রণয়ন হয়নি। আর এভাবেই স্থিমিত হয়ে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকার আদিগান্ত। কবে সঠিক তালিকা তৈরি হবে, আর কবে তা জনগণ দেখতে পারবে তা একমাত্র আল্লাহ্তায়ালাই জানেন।
খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদান ও ভাতা সম্পর্কে নীতিমালা হচ্ছে
সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদান ও মাসিক ভাতা প্রদানের লক্ষ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এই নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করার জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করার পর তা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদন প্রাপ্তির পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদান ও ভাতা প্রদান সম্পর্কে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করবে। অতিসম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদান ও মাসিক ভাতা প্রদান সম্পর্কে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদান ও মাসিক ভাতা প্রদানের ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে অনুদান ও ভাতা প্রদানের সম্পর্কে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি সারসংক্ষেপ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এ সভায়। সভায় বলা হয়, বর্তমানে ৬৭৬ জন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ২৯১ জন, নৌবাহিনীর ২১ জন, বিমান বাহিনীর ২৩ জন, বিজিবির ১১৮ জন, পুলিশ বাহিনীর ৫ জন এবং গণবাহিনীর ২১৮ জন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। মন্ত্রণালয়ে রক্ষিত তথ্যানুযায়ী বীরশ্রেষ্ঠ ৭ জন, বীরোত্তম ৬৮ জন, বীরবিক্রম ১৭৫ জন এবং বীরপ্রতীক ৪২৬ জন। এদের ভাতা ও অনুদানের বিষয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কিন্তু ওই প্রজ্ঞাপনে গণবাহিনীর খেতাবপ্রাপ্তদের কোন সংস্থা থেকে ভাতা প্রদান করা হবে এ ব্যাপারে কোন কিছুর উল্লেখ নেই। সভায় আরও বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হওয়ার আগে মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক বিষয়াদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নিষ্পত্তি করা হতো, এখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে। এ মন্ত্রণালয় থেকে সব খেতাবপ্রাপ্তকে ভাতা ও অনুদানের বিষয়ে আলাদাভাবে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করার প্রয়োজনেই এই নীতিমালা প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই নীতিমালার আলোকে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রদান করা হবে। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যদের অনুদান ও ভাতার অর্থ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের মাধ্যমে এবং পুলিশ, আনসার ও বিজিবি সদস্যদের অনুদান ও ভাতার অর্থ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এবং গণবাহিনীর সদস্যদের অনুদান ও ভাতার অর্থ বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রদান করা হয়।