দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ বিদেশ বিভুয়ে কাজ করতে গিয়ে গত ৮ বছরে প্রায় ১৬ হাজার কর্মী লাশ হয়ে দেশে ফিরেছে। সেই হিসেবে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ প্রবাসী লাশ হয়ে ফিরছে।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বিদেশ বিভুয়ে কাজ করতে যায় নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই প্রতারণার শিকার হন। আর সেক্ষেত্রে এদেশের অনেক নাগরিককে শেষ পর্যন্ত লাশ হয়ে দেশে ফিরতে হয়। এমন অনেক নজিরই আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় লেখা-লেখিও হয় কিন্তু সেই একই অবস্থা। কথায় বলে না, ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’, বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে এই প্রবণতা বেশি। কারণ গ্রামের সহজ-সরল মানুষ যারা দিন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা তারা বিদেশে যাওয়ার কথা শুনলে মনে করেন কি পেলাম! এই এরই সুযোগ নেন এক শ্রেণীর দালালরা। তারা গ্রামের মানুষের সরলতার সুযোগে হাতিয়ে নেন মোটা অংকের টাকা। জমি-জমা এমনকি অনেক সময় বাড়ি ঘর বিক্রি করে এসব প্রতারকদের ফাঁদে পা দেয়। বিদেশে যাবে অনেক টাকা আয় করবে, বড়লোক হয়ে যাবে রাতারাতি এমন ধারণা থেকেই প্রতারিত হন সাধারণ মানুষ।
ফরিদ উদ্দিন আহমদ
একজন ফরিদ উদ্দিন আহমদের কাহিনী দিয়ে শুরু করছি। ফরিদ উদ্দিন আহমদ এদেশেরই একজন নাগরিক। বুক ভরা স্বপ্ন ছিল তাদের। সহায়-সম্বল বিক্রি করে ধার-কর্জ করে বিদেশ গিয়েছিল। বিদেশ বিভুঁইয়ে কঠোর পরিশ্রম করে উপার্জন করে সংসারের কষ্ট লাঘব করবে সে স্বপ্ন তাদের অপূর্ণই থেকে গেল। ফিরে এলো লাশ হয়ে। গত ৮ বছরে প্রায় ১৬ হাজার কর্মী লাশ হয়ে স্বদেশে ফিরেছেন। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ প্রবাসী কর্মীর লাশ আসছে দেশে। সরকারি হিসাব মতে গত ৯ মাসে বিমানবন্দর হয়ে ২১১৭ কর্মীর মৃতদেহ দেশে এসেছে। এদের বেশির ভাগই মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাক অথবা দুর্ঘটনায়। হার্ট অ্যাটাকে কেউ মারা গেলে নিয়োগকারী সংস্থা থেকে কোন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিধান নেই। তবে কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় মারা গেলে মৃতের উত্তরাধিকারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান রয়েছে। কিন্তু আইনি জটিলতায় ওই টাকা পেতেও ব্যর্থ হচ্ছে বেশির ভাগ পরিবার।
মালয়েশিয়ায় মারা যাওয়া টাঙ্গাইলের মহেশ সরকারকে নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠেছিল। অসুস্থ হওয়ার পরও হাসপাতালে ভর্তি না করায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি। এ নিয়ে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশীরা আন্দোলনে পর্যন্ত নামেন। কিন্তু মহেশের বিধবা স্ত্রী ঝর্ণা সরকার ও দুই মেয়ে অনামিকা ও মিথিলা ক্ষতিপূরণের কানাকড়িও পাননি। এ পথে বাধার দেয়াল হচ্ছে আইনের জটিলতা। উত্তরাধিকার প্রমাণের জন্য আদালতে মামলা পর্যন্ত করেছেন তারা। তাতেও কাজ হয়নি। শুধু মহেশের পরিবারই নয়, ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে শ’ শ’ অসহায় পরিবার প্রতিদিন বিএমইটি’র দ্বারে দ্বারে ধরনা দিচ্ছে।
প্রতারণার আরও কাহিনী
বিদেশে গিয়েই যে প্রতারিত হচ্ছে শুধু তাই নয়। দেশে থাকা অবস্থায়ও অনেকে প্রতারিত হচ্ছেন। মুকুল ও ফরিদ যাদের বাড়ি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী। তারা দুজনই বিদেশে যাওয়ার জন্য পাগল। মুকুল ঈশ্বরদী পৌরসভায় একটি চাকরি করতো। আর ফরিদ একজন রেডিও-টিভি মেকার। দুজরেই ইনকাম সোর্স রয়েছে, তারপরও তারা বিদেশে গিয়ে সচ্ছল জীবন যাপন করার জন্য পাগল প্রায়। এমন সময় তার খোঁজ পেলো মরিসাচে যাওয়ার জন্য লোক দরকার। তারা শুনে বড়ই খুশি, তখন তারা ঢাকায় গেলো সে আরও দু’বছর আগের কাহিনী। তারা একজন মুকুল ২০ হাজার এবং ফরিদ ৩০ হাজার টাকা দিল এক দালালকে। কিন্তু টাকা পাওয়ার পর আজ নয় কাল এমন ভাবে চলতে থাকলো বছর খানেক। পরে জানা গেলো আসলে সে মরিসাচ পাঠাতে পারবেই না, টাকা ফেরত দিবে। প্রথমে টাকা আজ দিচ্ছি তো কাল দিচ্ছি এভাবে গেলো। পরে একজন পরিচিত লোকের মাধ্যমে অর্থাৎ যার মাধ্যমে তিনি টাকা দিয়েছিলেন তার মাধ্যমে অনেক কষ্টে টাকাগুলো উদ্ধার করেন। যদিও সামান্য কিছু টাকা এখনও নাকি পাওনা রয়েছে। যাক সেখানকার কাহিনী। শুরু হলো আরেক কাহিনী। সাউথ আফ্রিকা যাওয়ার কাহিনী। মুকুলের বড় ভাই এর এক ক্লোজ বন্ধুর ভাতিজা থাকেন সাউথ আফ্রিকা। যে কারণে সেই বিশ্বাসে তাকে দেন তিন লাখ টাকা। সব ঠিকঠাক। ফ্লাইটের তারিখ হয়। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে গিয়ে প্লেনেও চড়েন মুকুল। কিন্তু বিধি বাম। যেখানেই যান না কেনো, কপাল তো খুলে রেখে যেতে পারবেন না। জোহানেসবার্গ বিমান বন্ধরে গিয়ে আটকে গেলেন মুকুল। কথা ছিল জোহানেসবার্গ বিমান বন্দর গিয়ে ওখানকার লোক এসে ডমেস্টিক ফ্লাইটে অন্যখানে নিয়ে গিয়ে তাকে ভেতরে প্রবেশ করাবে। কিন্তু বিমান বন্দরে ওদের সেই লোক আসলেও মুকুলকে নিতে পারেননি। অবশেষে বিষয়টি বিমান বন্দর পুলিশ যেনে ফেলে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে উদ্যত হলে মুকুল অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন অন্যান্য যাত্রীর অনুরোধে বিমান বন্দর পুলিশ তাকে গ্রেফতার না করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠান। বাংলাদেশে তার কোন সমস্যা না হলেও যাদের সঙ্গে কন্টাক্ট হয়েছিল তারা আজও তার টাকা দেয়নি এবং বিদেশেও পাঠাতে পারেনি। এই হলো মুকুলের কাহিনী। ওই কাহিনীর সঙ্গে ফরিদও জড়িত। ফরিদও টাকা দিয়েছে ওই পার্টিকে। সেও টাকা না পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর মুকুলতো পৌরসভার চাকরি ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল। তাই সে এখন একেবারে বেকার। আমাদের দেশের অনেক মানুষ রয়েছে যারা বিদেশে যাওয়ার জন্য পাগল মুকুল ও ফরিদ তাদের মধ্যে পড়ে। দেশে থেকে চাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্য করে অনায়াসে চলা সম্ভব ছিল কিন্তু তা না করে তারা পাগল হলেন বিদেশে যাওয়ার জন্য।
বিএমইটি তথ্যমতে, এ বছরের জুলাই মাসে ১৭০টি মৃতদেহ দেশে এসেছে বিমানবন্দর হয়ে। এর মধ্যে ৬৮ জন হার্ট অ্যাটাক ও ৫৭ কর্মীর মৃত্যুর কারণ দেখানো হয়েছে দুর্ঘটনা। আগস্টে মৃতদেহ এসেছে ১৭৩টি। সেপ্টেম্বরে এসেছে ২২৪টি লাশ। এখানেও হার্ট অ্যাটাক ও দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) পরিচালক কল্যাণ মোহসীন চৌধুরী বলেছেন, কর্মরত অবস্থায় কোন কর্মী মারা গেলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সেই দেশের আইনের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে একটু সময় লাগে। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে তিনি কার দোষে মারা গেলেন আইনে তা দেখে সেভাবে ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়। আমাদের দেশ থেকে যেসব কর্মী বিদেশ যান, তাদের বয়স ২৫-৪০, ওখানে গিয়ে অনেকের আশা সঠিকভাবে পূরণ হয় না। তারা হতাশায় পড়ে যান। এছাড়া খাদ্যাভ্যাস, কাজের পরিবেশ এবং মানসিক চাপের কারণে অনেকেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। সব লাশ দেশে আসে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব লাশ আসে না। সৌদি থেকে এক-তৃতীয়াংশ লাশ আসে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব মৃতের পরিবার আইনি জটিলতায় ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। সংশিস্নষ্ট দেশগুলোর শ্রম আইনের জটিল নিয়মও ভোগান্তির আরেক অধ্যায় বলে জানিয়েছেন প্রবাসীরা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে এই জটিলতা ও ভোগান্তি কমানো সম্ভব বলে জানান প্রবাসী কর্মীরা। বিএমইটি সূত্র জানায়, স্বাভাবিক ও হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হলে নিয়োগকর্তার থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায় না। কর্মরত অবস্থায় সংশিস্নষ্ট দেশের কোম্পানিতে ও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেই ক্ষতিপূরণ আদায় সম্ভব। তবে যেসব হতভাগ্য নিয়োগকর্তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পান না, তাদের পরিবারকে ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক অনুদান দেয়া হয়। পক্ষান্তরে মেডিকেল রিপোর্টে বেশির ভাগ মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক দেখানোয় নিহতের আত্মীয়স্বজনদের পক্ষে কোম্পানির কাছে ক্ষতিপূরণ পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জানা যায়, কেবলমাত্র বহির্গমন ছাড়পত্রধারী কর্মী কর্মরত অবস্থায় মারা গেলে ক্ষতিপূরণ বা সহায়তা পেয়ে থাকেন। বহির্গমন ছাড়পত্র ছাড়াও যদি কেউ বৈধভাবে কাজ করেন এবং আমাদের দূতাবাস যদি তা স্বীকার করে, তবে সেক্ষেত্রে কল্যাণ বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী এ সুবিধা পাওয়া সম্ভব। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে সবার আগে নিহতের পরিবারকে উত্তরাধিকারের প্রমাণ দিতে হবে। প্রয়োজনে আদালতের মাধ্যমে উত্তরাধিকারের সমস্যা নিষ্পত্তি করে আসতে হবে। এই জন্য প্রয়োজন জেলা জনশক্তি অফিসারের সম্মতিপত্র। দেশে জনশক্তি অফিস আছে মাত্র ২১টি জেলায়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে টাকাটা দেয়া হবে, সেটা বিদেশে কাজ নিয়ে যাওয়ার আগে ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ তহবিলে জমা রাখা কর্মীদেরই টাকা।
বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে ১২৪৮, ২০০৬ সালে ১৪০২, ২০০৭ সালে ১৬৭৩, ২০০৮ সালে ২৯৮, ২০০৯ সালে ২৩১৫, ২০১০ সালে ২৫৬০, ২০১১ সালে ২৫৮৫ ও এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে মারা গেছেন ২১১৭ কর্মী। সবমিলে ৮ বছরে ১৫ হাজার ৯৯৮ জন কর্মী মারা গেছেন। শুধু সেপ্টেম্বরে এসেছে ২২৪টি লাশ। সৌদি আরব থেকে ৪৫৫ লাশ, মালয়েশিয়া থেকে ২২১, কুয়েত থেকে ৮৩, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২৪৪, বাহরাইন থেকে ৪২, ভারত থেকে ৫৬, ওমান থেকে ৯৫, মার্কিন যক্তরাষ্ট্র থেকে ৫১, সিঙ্গাপুর থেকে ৩৭, জর্ডান থেকে ৩, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৫৫, কাতার থেকে ২৫, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২, সাইপ্রাস থেকে ১, লিবিয়া থেকে ৯, যুক্তরাজ্য থেকে ১৮, ইতালি থেকে ৩৫, লেবানন থেকে ১৫, গ্রীস থেকে ১৪, পাকিস্তান থেকে ১০, হংকং থেকে ১, চীন থেকে ২, জার্মানি ৪, থাইল্যান্ড ১৯, ফ্রান্স ৮, ব্রুনাই ৮, জাপান ১, মিশর ৫, অস্ট্রেলিয়া ৩, আফগানিস্তান ১, কানাডা থেকে ৫, রাশিয়া ১, স্পেন ২, শ্রীলঙ্কা ২, বেলজিয়াম ৪, সুদান ১, মোজাম্বিক ১, মালদ্বীপ ২, আলজেরিয়া ১, মরিশাস ১, ইরাক ৩ লাশ সহ ৯ মাসে মোট ১৭৩২টি লাশ এসেছে। এগুলো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আসা লাশের হিসাব। এছাড়াও চট্টগ্রাম শাহ্ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৩২৮ ও সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে আরও ৫৭টি লাশ এসেছে। সবমিলিয়ে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২১১৭টি লাশ এসেছে। কাগজপত্র সঠিক থাকা সাপেক্ষে লাশ পরিবহন ও দাফনের জন্য ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ তহবিল থেকে নিহতের পরিবারকে ৩৫ হাজার টাকা দেয়া হয় বিমানবন্দরে।
এরপর থেমে যায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সব কিছু। পরিবারের উপার্জনক্ষম একজন মানুষ যখন সেই পরিবারের আর থাকেন না, তখন এর মাশুল গুণতে হয় ওই পরিবারকেই। কিন্তু কেও কি দেখতে আসছে এসব পরিবারের করুণ কাহিনী? বিশেষ করে গ্রামের সহায় সম্বলহীন মানুষের জন্য কি এক করুণ পরিণতি ডেকে আনে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করানো যাবে না।