দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ পার হয়ে গেলো বিশ্ব মা দিবস। মা দিবসে এক মায়ের কথা উঠে এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। একাত্তরের লড়াইয়ের এক সৈনিক রমা চৌধুরী। তিনি বলেছেন সন্তানদের সম্পর্কে।
স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর। চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পোড়া ভিটের এক কোণে নিজের কোলের শিশুকে বাঁচাতে লড়ছিলেন এক মা, তিনি হলেন রমা চৌধুরী। সেদিন নিয়তির কাছে হার মানতে হয়েছিল তাঁকে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত তাঁর বড় ছেলে সাগর মারা গেলো। এর ঠিক দুই মাস যেতে না যেতেই মারা যায় মেজ ছেলে টগর। ছেলেদের দেহ মাটিতে মিশে গেছে। তাই পুত্রশোকে জুতা পরা বাদ দিয়েছেন তিনি। পরে অনিয়মিতভাবে জুতা ব্যবহার করা শুরু করেন কিন্তু তাঁর ছোট ছেলের মৃত্যু তাঁকে আবারও তছনছ করে দেয়। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর হতে গত ১৯ বছরে পায়ে আর কখনও জুতা তোলেননি দুঃখিনী এই মা।
মা দিবস উপলক্ষে সংবাদ মাধ্যমকে সন্তানহারা মা রমা চৌধুরী বলেছেন, ‘আমার ছেলেদের আমি পোড়াতে দিইনি। এই মাটিতেই তারা শুয়ে রয়েছে। আমি সেই মাটিতে কীভাবে জুতা পায়ে হাঁটি? পারলে তো নিজের বুক দিয়ে চলতাম-ফিরতাম।’
সেই ১৯৭১ সালের বিভীষিকাময় ঘটনা, সন্তানদের মৃত্যুর ক্ষণ এখনও জ্বলজ্বল করে রমা চৌধুরীর মনে। তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময় তাঁর ছেলে সাগরের বয়স ছিল মাত্র সাড়ে ৫ বছর। দুরন্ত শিশুটি মিছিলের পেছন পেছন ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ বলে ছুটে বেড়াতো। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়ে তাঁর সন্তান। অনেক চেষ্টা করেও বুকে আগলে রাখতে পারেননি রমা চৌধুরী। সাগরের মৃত্যুর ১ মাস ২৮ দিনের মাথায় মারা গেলো ৩ বছর বয়সী টগরও!
রমা চৌধুরীর বিভীষিকার শুরু প্রথম ছেলের মৃত্যুর ৭ মাস আগে থেকেই। সেদিন ছিল একাত্তরের ১৩ মে (বাংলায় ২৯ বৈশাখ)। তাঁর মনে এখনও দগদগে ক্ষত হয়ে রয়েছে এই দিনটি। সেদিন তিনি হায়েছিলেন সম্ভ্রম, বাড়িঘর। ওই বিভীষিকার বর্ণনা রয়েছে তাঁর একাত্তরের জননী বইতে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘যখন আমাকে নির্যাতন করার হন্য উদ্যত হলো পাক সেনা, তখন জানালার পাশে দাঁড়ানো আমার মা ও দুই ছেলে বারবার তাদের আকুতি করছিলেন। সেখানে ছিল আমার পোষা বিড়াল কনুও। তখন আমি আমার মাকে সন্তানদের নিয়ে সরে যেতে বলেছিলাম।’
তবে কী আশ্চর্য বিষয় হলো! ৪৬ বছর পর এই সাক্ষাৎটি দেন সেই ১৩ মে তারিখেই মা দিবসের প্রাক্কালে! তিনি বলেন তাঁর আজীবন জীবনসংগ্রামের কথা। ১৯৭১ সালে রমা চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর বিদুগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকা। লেখালেখিও করতেন ছোটবেলা হতে। যুদ্ধ শুরু হলে স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে রেখে ভারতে চলে যান তাঁর স্বামী। এরপর থেকে তাঁর দুঃখের দিন শুরু হয়।
একাত্তরের জননী বইয়ের মুখবন্ধে রমা চৌধুরী আরও লিখেছেন, ‘পাক হানাদার বাহিনী আমাকে প্রাণে না মারলেও আমার আত্মার অপমৃত্যু ঘটিয়েছে সেদিন, যে কারণে আমার জীবনে নেমে এসেছে শোচনীয় পরিণতি। আমার দুটি মুক্তিপাগল অবোধ শিশুর সাধ স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা, ভরা জীবন কেড়ে নিয়েছে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম…।’
তিনি জানান, দুই ছেলেকে হারিয়ে রমা চৌধুরী তখন উদ্ভ্রান্তের মতো জীবনযাপন করছিলেন। পাড়ার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জোটে নানা অপবাদ। সন্তান হারিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় তাঁর পায়ে ঘা হয়ে যায়। স্বজনদের অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর অনিয়মিতভাবে জুতা পায়ে দিতে শুরু করেন রমা চৌধুরী। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে তাঁর ছোট ছেলে ২১ বছর বয়সী টুনু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর হতে আবারও জুতা পরা ছেড়ে দেন রমা চৌধুরী। খালি পায়ে নিজের লেখা বই ফেরি করে বেড়াতেন তিনি। কারও দয়া-দাক্ষিণ্যে চলতে চান না রমা চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে ডেকে সহায়তার হাত বাড়াতে চাইলেও বিনয়ের সঙ্গে তিনি তা ফিরিয়ে দেন।
এই মহিয়ষী জননী রমা চৌধুরীর ১৮টি বই বের হয়েছে। তাঁর ছায়াসঙ্গী বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দিন খোকন। খোকন মায়ের মতোই সেবা-শুশ্রূষা করেন রমা চৌধুরীকে।
আলাউদ্দিন খোকন বলেছেন, বই বিক্রি করেই তিনি সংসার চালান। চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড়ের লুসাই ভবনের চারতলার একটি কক্ষে তিনি বসবাস করেন। একাত্তরে পুড়ে যাওয়া তাঁর বসতভিটা এতোদিন অর্থের অভাবে ঠিক করাতে পারেননি তিনি। তবে সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য একটি সংস্থার কাছ থেকে সম্মাননা হিসেবে অর্থ পেয়েছেন তিনি। এই টাকা দিয়ে ৪৬ বছর পর বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামের পুড়ে যাওয়া সেই বাড়িটি ঠিক করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
এই জননী রমা চৌধুরী পুত্রশোক ভুলে থাকেন পোষা বিড়ালগুলোকে কোলে নিয়ে। ৩/৪টি বিড়াল পোষেন তিনি। বিড়ালদের নিয়েই সন্তানহারা এই মায়ের সংসার চলছে। শরীর ভালো থাকলে খালি পায়ে কাঁধের ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ৭৪ বছর বয়সী এই মহিয়ষী নারী। তিনি বলেছেন, ‘আমার সন্তানেরা শহীদের মর্যাদা পায়নি, তবে তারা আমার কাছে শহীদ। কারণ, একাত্তর আমাকে দিয়েছে পোড়া ভিটে, কাঁধের ঝোলা, ছেলের শোক ও খালি পা।’