দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ একটি কংকাল। তার কিই বা মোজেজা আছে। অথচ সামান্য ওই কংকাল থেকে বেরিয়ে এলো সিপাহি বিদ্রোহের অজানা অধ্যায়! শুনলে বিস্ময়কর মনে হয়।
ইতিহাসবিদ কিম ওয়াগনার ২০১৪ সালে লন্ডনের মাইল এন্ডে নিজের অফিস কক্ষে কাজ করার সময় একটি ইমেইল পান। যে ইমেইলে এক দম্পতি লিখেছেন যে, তাদের কাছে কংকালের মাথার খুলি রয়েছে। সেটি তারা তাদের বাড়িতে রাখতে চান না। কিন্তু বুঝতেও পারছেন না তাদের আসলে কী করা উচিত।
তবে ওই কংকালের বাকি অংশ নেই। কয়েকটি দাঁতও ইতিমধ্যেই ছুটে গেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার সঙ্গে থাকা কাগজটি। সেখানে একটি নোটে এই খুলির পরিচয় লেখা আছে।!
ওই খুলিটি হাবিলদার আলম বেগের। তিনি ৪৬ বেঙ্গল নর্থ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের একজন সৈনিক ছিলেন, তিনি তার রেজিমেন্টের আরও কয়েকজনের সঙ্গে বন্দুকের গুলিতে নিহত হন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান নেতা।
জানা যায়, হাবিলদার আলম বেগ একটি ছোট দল নিয়ে কেল্লার দিকে যাওয়ার রাস্তাটি দখল করেন, যেখান থেকে ইউরোপিয়ানরা নিরাপদে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। তিনি ঘোড়ার গাড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে কন্যার সামনেই ড. গ্রাহামকে হত্যা করেন। তার পরবর্তী শিকার ছিলেন রেভারেন্ড হান্টার, একজন মিশনারি, যিনি তার স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে পালাচ্ছিলেন। ড. হান্টারকে হত্যার পর তিনি তার স্ত্রী ও কন্যাকেও চরম নির্যাতন করে জবাই করে হত্যা করেছিলেন।
আলম বেগের বয়স ছিল মাত্র ৩২, ৫ ফিট সাড়ে ৭ ইঞ্চি লম্বা ও কোনো ভাবেই স্থানীয়দের মতো ছিলেন না। এই খুলিটি ক্যাপ্টেন (এআর) কোস্টেলো দেশে নিয়ে আসেন, যিনি ওই আলম বেগের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় উপস্থিত ছিলেন।
এই নোট থেকে যেটি পরিষ্কার হয় সেটি হলো যে, এই খুলিটি আলম বেগ নামের একজন ভারতীয় বিদ্রোহী সেনার, যিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টে কাজ করতেন ও ১৮৫৮ সালে পাঞ্জাবের কামানের মুখে বেধে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিলো। যিনি এই নোটটি লিখেছেন, তিনিই খুলিটি ইংল্যান্ডে নিয়ে এসেছিলেন। তবে প্রশ্ন হলো কেনো আলম বেগ যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, সে বিষয়ে নোটে কিছুই বলা নেই।
সংবাদ মাধ্যমের এক তথ্যে বলা হয়েছে, কার্তুজে মাখানো পশুর চর্বি ব্যবহার করলে তা ধর্মবিরোধী হবে, সেই কারণে ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম সেনারা। তার আগে পরে মিলিয়ে ব্রিটিশরা প্রায় ২শ বছর ভারত শাসন করেছে।
এই দম্পতি ওই কংকাল খুলিটির বিষয়ে জানতে, আলম বেগের ইন্টারনেটে যথেষ্ট খোঁজাখুঁজি করেন। তবে সেখানে কিছু না পেয়ে শেষ পর্যন্ত এই অধ্যাপকের শরণাপন্ন হন।
এরপর নভেম্বর মাসে এই দম্পতির সঙ্গে দেখা হয় অধ্যাপক ওয়াগনারের। তারা জানান যে, পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে তারা এই কংকাল খুলির মালিক হয়েছেন।
কিভাবে কংকালটি পেয়েছেন সে বিষয়ে বলেছেন, তাদের একজন আত্মীয় কেন্টে একটি ছোট পাব কিনেছিলেন। তখন সেখানে একটি রুমে পুরনো বাক্স পেটরার মধ্যে এই খুলিটি পান। কেও জানতো না পাবে কিভাবে খুলিটি এসেছে। কিছুদিন সেটা পাবের মানুষজনকে দেখার জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছিলো। ওই দোকানের মালিক মারা যাওয়ার পর নানা হাত ঘুরে খুলিটি এই দম্পতির হাতে চলে আসে।
তারপর ওই খুলির অতীত খুঁজে বের করার কাজে নামেন ড. ওয়াগনার। প্রথমেই তাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, খুলিটির সঙ্গে ইতিহাসের সত্যিই কোনো যোগাযোগ রয়েছে কি না। সেজন্য তিনি লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের শরণাপন্ন হন। একজন বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মতামত দেন যে, এটা মধ্য উনিশ শতকের এশিয়ান কোনো এক যুবকের মাথার খুলি। যার বয়স হতে পারে আনুমানিক ত্রিশের কোঠায়।
অবশ্য কংকাল খুলি দেখে কিভাবে তিনি মারা গেছেন সেটি বোঝার কোনও উপায় নেই। তাছাড়া কামানের গোলায় মারা গেলে সেটি অস্বাভাবিকও নয়।
ড. ওয়াগনার আশা করেননি যে তিনি এই ব্যক্তি সম্পর্কে খুব তাড়াতাড়িই কিছু জানতে পারবেন। কারণ সাধারণত ছোট সেনাদের বিষয়ে খুব একটা নথিপত্র কখনও থাকে না।
ব্রিটেন বা ভারতের আর্কাইভে বহু খুঁজেও বেগের নাম বা কোনো কাগজপত্র, প্রতিবেদন, চিঠি বা স্মরণিকাও পাওয়া গেলো না।
কিন্তু এখানে কিছু সূত্রের দেখা পেলেন ড. ওয়াগনার। আলম বেগ যাদের হত্যা করেছিলেন বলে বলা হচ্ছে, তাদের পরিবারের কিছু চিঠি-পত্র পেলেন ড. ওয়াগনার। সেখানে অ্যান্ড্রু গর্ডন নামে একজনের কথা জানা গেলো, যিনি নিহত ডা. গ্রাহাম ও হান্টারকে জানতেন এবং বেগের মৃত্যুদণ্ডের সময় উপস্থিতও ছিলেন।
পাওয়া এসব তথ্যকে সূত্র ধরে অনুসন্ধান শুরু করলেন ড. ওয়াগনার। লন্ডন ও দিল্লির আর্কাইভ ঘাটতে শুরু করেন তিনি। এখনকার পাকিস্তানের শিয়ালকোট হতে চারদিনের দূরত্বে, দেড়শ বছর আগের সেই যুদ্ধক্ষেত্রও তিনি খুঁজে বের করলেন, যেখানে আলম বেগ ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গিয়েছিলেন।
ওই বিদ্রোহের বইপত্র, চিঠি, পিটিশন, বিবৃতি ঘাটাঘাটি করে অবশেষে আলম বেগের বিষয়ে এই উপসংহারে পৌঁছাতে পারেন ড. ওয়াগনার। সেই বর্ণনা নিয়ে তিনি ‘আলম বেগের খুলি’ নামের একটি বইও লিখছেন।
প্রকৃতপক্ষে তার সত্যিকারের নাম আলিম বেগ, যিনি ছিলেন উত্তর ভারতের একজন সুন্নি মুসলমান। বর্তমান উত্তর প্রদেশের কানপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টটি গঠিত হয়। আলিম বেগও সেই এলাকা হতে এসেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি ছোট একটি সেনা বাহিনীর দলের দায়িত্বে ছিলেন। মূলত যাদের কাজ ছিল ক্যাম্প পাহারা দেওয়া, চিঠিপত্র বহন করা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপরাশি হিসাবে ফার ফরমায়েশ পালন করা।
তবে যিনি ওই খুলিটি ব্রিটেনে এনেছিলেন, তার পরিচয়ও পাওয়া গেছে, ক্যাপ্টেন রবার্ট জর্জ কোস্টেলো। আয়ারল্যান্ডে জন্ম ও ১৯৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে ভারতে আসেন। এর ১০ মাস পর তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
ড. ওয়াগনার বলেছেন, ‘আমার গবেষণার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, আলিম বেগকে আবার ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, যদি সেটি সম্ভব হয়।’
এখন পর্যন্ত এই কংকাল খুলির জন্য কোনো দাবি আসেনি। তবে ভারতের নানা প্রতিষ্ঠান ও ভারতে ব্রিটিশ হাই কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন ড. ওয়াগনার।
ড. ওয়াগনার বলেছেন, আমি চাই না, আলিম বেগের এই মাথার খুলি কোনো রাজনৈতিক ইস্যু হোক বা কোনো মিউজিয়ামের কাচের বক্সে শোভা পাক, কিংবা কোনো বাক্সে পড়ে থাকুক। আমি চাই যে, আলিম বেগ তার দেশে ফেরত যাক ও সম্মানের সঙ্গে তার দেশের মাটিতেই শুয়ে থাকুক।
ড. ওয়াগনার মনে করেন, আলিম বেগের কবর হওয়া উচিত রাভী নদীর মাঝের ছোট দ্বীপটিতে, যেখানে তিনি ও তার সঙ্গের সেনারা ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন সেই দ্বীপটি ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা। তাই আলিম বেগের চূড়ান্ত অধ্যায় লেখার এখনও কিছু বাকি রয়ে গেছে বলে মনে করেন ড. ওয়াগনার।