ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ শান্তি পানি যখন প্রথমে বাজারে আসলো তখন থেকেই এই পানি নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। কারণ ঢাকা ওয়াসার সাপ্লাই পানি নিয়ে এমনিতেই অভিযোগের শেষ নেই। তারওপর ওয়াসা যখন প্রথম পানি বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দিলো তখনই শুরু হয় নানা কানা-ঘুষা। এখন বাস্তবে শুরু হয়েছে এর অব্যবস্থা এখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে ঢাকা ওয়াসা।
পত্রিকান্তরের খবরে প্রকাশ, ঢাকা ব্যাংকের উচ্চপদস্থ দু’জন কর্মকর্তার সিল ও স্বাক্ষর জাল করে পারফরম্যান্স গ্যারান্টি মানি জমা দিয়েছে শান্তি পানি উৎপাদনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এএমই ইঞ্জিনিয়ার্স। অব্যাহতভাবে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করার পরিপ্রেক্ষিতে এ জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়েছে এক বছর পর। অথচ নিয়ম থাকলেও চুক্তির সময় ওয়াসার বোতলজাত মিনারেল ওয়াটার প্লান্ট কর্তৃপক্ষ ব্যাংকের পারফরম্যান্স গ্যারান্টি যাচাই করে দেখেনি। সংশ্লিষ্ট অনেকেই আশংকা করছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও শান্তি পানি প্লান্ট কর্তৃপক্ষের কারও না কারও যোগসাজশে জালিয়াতির এ ঘটনা ঘটেছে।
সূত্র জানায়, বোতল উৎপাদন থেকে শুরু করে পানি বাজারজাতকরণের চূড়ান্ত প্যাকেজিং প্রক্রিয়া পর্যন্ত সব ধাপের কাজের জন্য ২০১০ সালের নভেম্বরে শান্তি পানি প্লান্ট কর্তৃপক্ষ ওটিএম (উন্মুক্ত দরপত্র) পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করে। এতে সর্বনিম্ন দরদাতা বিবেচিত হয় এএমই ইঞ্জিনিয়ার্স। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন ৩০ হাজার লিটার বোতলজাত পানির চূড়ান্ত উৎপাদনসহ প্রতি ১ হাজার লিটার পানি উৎপাদন করতে ৭৪০ টাকা দর দেয়। এ কাজে ২ বছরের জন্য মোট উৎপাদন খরচ হিসাবে দর দেয়া হয় ১ কোটি ৩৮ লাখ ৬৫ হাজার ২৮০ টাকা। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যান্ত্রিক, কারিগরি ও কাঁচামাল সরবরাহ করবে শান্তি পানি প্লান্ট কর্তৃপক্ষ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রতিদিন ৫৫ জন শ্রমিক নিয়োগ করে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উৎপাদনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। এভাবে চুক্তি সম্পাদিত হয় ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর। ওইদিনই মোট দরের ১০ শতাংশ পারফরম্যান্স গ্যারান্টি জমা দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে প্লান্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করা হয় ১৫০ টাকার স্ট্যাম্পের ওপর ঢাকা ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার দুই পাতার ব্যাংক গ্যারান্টিপত্র। সেখানে ওই ব্যাংকে গ্যারান্টি হিসেবে ১৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫২৮ টাকা গচ্ছিত আছে বলে নিশ্চিত করা হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চুক্তির শর্ত লংঘন করলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্লান্ট কর্তৃপক্ষ ব্যাংক গ্যারান্টির টাকা তুলে নিতে পারবে।
প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্ব নেয়ার পর কিছুদিন চুক্তি মেনে কাজ করলেও পরে শর্ত লংঘন শুরু করে। দৈনিক ৩০ হাজার লিটার বোতলজাত পানি উৎপাদন করার পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৫ হাজার লিটার উৎপাদন করে। ৫৫ জন শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোর কথা থাকলেও তা কমিয়ে ২০ জনে নিয়ে আসে। এতে লোকসানের মুখে পড়ে শান্তি পানি। এরপর শর্ত লংঘনের দায়ে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে ব্যাংক গ্যারান্টি তুলে নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর শান্তি প্লান্ট কর্তৃপক্ষ ঢাকা ব্যাংকের ধানমণ্ডি শাখার ম্যানেজারকে চিঠি দেয়। ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা ব্যাংক থেকে শান্তি পানির প্লান্ট ম্যানেজারকে জানিয়ে দেয়া হয়, এ ধরনের কোন পারফরম্যান্স গ্যারান্টির টাকা তার শাখায় জমা নেই এবং এ শাখা থেকে এ ধরনের কোন ব্যাংক গ্যারান্টিপত্র দেয়া হয়নি। যে ব্যাংক গ্যারান্টির ডকুমেন্ট পেপার সরবরাহ করা হয়েছে তা শতভাগ জাল। ব্যাংকের ম্যানেজার মোশতাক আহমেদ খান ও সিনিয়র সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট মির্জা ইসমাইল হোসেনের স্বাক্ষর জাল করে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
ব্যাংক গ্যারান্টি জালিয়াতির বিষয়ে ১৫ এপ্রিল ধানমণ্ডির ঢাকা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় গিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংক ম্যানেজার মোশতাক আহমেদ খান এ-সংক্রান্ত সব চিঠিপত্র দেখিয়ে বলেন, এখানে ঢাকা ব্যাংকের কোন দায় নেই। ওয়াসা জানতে চাওয়ার তিন দিনের মধ্যে তারা জালিয়াতির বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মালিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টটিতে সব ধরনের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পুলিশকেও জানানো হয়েছে। তিনি জানান, ব্যাংকের চিঠির জবাবে জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকার ও দুঃখ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারও ২ জানুয়ারি ব্যাংককে চিঠি দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ জালিয়াতি প্রক্রিয়ার সঙ্গে শান্তি পানি প্লান্টের প্রভাবশালী একজন কর্মকর্তা জড়িত। বিশেষ সমঝোতার কারণে এ ধরনের ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দিতে ওই কর্মকর্তাই ঠিকাদারকে উৎসাহিত করেছিলেন। পরে বিরোধ দেখা দিলে ভুয়া পারফরম্যান্স গ্যারান্টির কারণে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছিলেন না। এতে শান্তি পানির স্বাভাবিক উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয় এবং প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের মুখে পড়ে।
এ বিষয়ে ব্যাংক গ্যারান্টিপত্র সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী শেখ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওয়াসা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন মন্তব্য করবেন না তিনি। ব্যাংকের কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে পারফরম্যান্স গ্যারান্টিপত্র জমা দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে অপর প্রান্ত থেকে তিনি ফোনকলটি কেটে দেন।
এদিকে শান্তি প্লান্টের ম্যানেজার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রবিউল কাইজারের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। ব্যাংক গ্যারান্টি যাচাই করতে এক বছর কেন বিলম্ব হল, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই সময় ব্যাংককে ফোন করলে একজন কর্মকর্তা ব্যাংক গ্যারান্টির সত্যতা স্বীকার করেন। এ জন্য তিনি সরেজমিনে গিয়ে আর খোঁজ নেননি। তবে জালিয়াতির বিষয়টি এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। শিগগির এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনার দায় কোন অবস্থাতেই প্লান্ট ম্যানেজার এড়াতে পারবেন না। নিয়মানুযায়ী পারফরম্যান্স গ্যারান্টিপত্র পাওয়ার পর তা ওই সময়ই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে সরেজমিনে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হতে হতো। এটা প্লান্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব। বরং তিনি এক বছর ধরে যাচাই না করায় নানা সন্দেহ ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বিষয়গুলোর তদন্ত হলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।