ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ বাংলাদেশের এই প্রথম কোন নারী বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট বিজয় করেছেন। তার নাম নিশাত।
দীর্ঘ ৯ বছরের অদম্য চেষ্টা আর নিয়মতান্ত্রিক পরিশ্রমের ফলে প্রথম বাংলাদেশী নারী হিসেবে ১৮ মে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট চূড়ায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়েছেন নিশাত মজুমদার।
ঢাকা ওয়াসার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নিশাতের পর্বতারোহণের শুরু সেই ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশ এস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায়। পরে বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) সদস্য হিসেবে তিল তিল করে গড়েছেন নিজের বিজয়ের সোপান। বরাবরই নিশাতের স্বপ্ন ছিল একদিন এভারেস্ট জয় করবেন। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ১৮ মে সকাল সাড়ে ৯টায়। এ সময় সামিট পুশ (চূড়ায় ওঠা) করেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন দ্বিতীয়বারের মতো এভারেস্ট জয় করা বাংলাদেশী এমএ মুহিত। ১৬ মে তাদের সামিট পুশ করার কথা ছিল। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়ার কারণে তা দু’দিন বিলম্বিত হয় বলে জানা গেছে। তবে নেপালস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস এখনও এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেনি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিশাত ও মুহিত আজ ১৯ মে বিকাল নাগাদ এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে এসে পৌঁছবেন। তখনই দূতাবাসসহ নেপালের কর্তৃপক্ষ সংস্থা বিষয়টি নিশ্চিত করবে এবং তাদের এভারেস্ট জয়ের সনদপত্র দেয়া হবে। এর আগে ১৮ মে রাতে তাদের দু’জনের সাড়ে ছয় হাজার মিটার উঁচু ‘ক্যাম্প-২’-এ অবস্থান করার কথা।
নিশাতের এ অর্জনে তার মুক্তিযোদ্ধা বাবা কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের মহাসচিব আবদুল মান্নান মজুমদার অত্যন্ত গর্বিত। তিনি বলেন, আমি তাকে বাঙালি মেয়েদের মুক্তির একজন প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করছি। যখন দেশে নারীদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘরে বন্দি করে রাখার সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্র চলছে সে সময় মেয়েদের পক্ষে এমন একটি গৌরব ছিনিয়ে এনেছে। এ ঘটনায় বাবা হিসেবে আমি অত্যন্ত গর্বিত। এ প্রসঙ্গে নিশাতের মা বলেন, আমি অবশ্যই গর্বিত ও আনন্দিত। তবে শৃঙ্গ থেকে ফিরে আসা ঝুঁকিপূর্ণ। ফিরে না আসা পর্যন্ত স্বস্তিতে থাকতে পারছি না।
শুধু পরিবারের সদস্যরা নন, ঢাকা সিটি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা নিশাতের এ অর্জনে গর্বিত বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকও। সকালে তার এভারেস্ট বিজয়ের খবর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ তার উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করে। নিশাতের জন্মস্থান লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলায় আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া নিশাতের গ্রিন রোডের বাসাতেও সকাল থেকেই ফুল ও মিষ্টি হাতে ভিড় জমাতে শুরু করেন শুভানুধ্যায়ীরা। সূত্র জানায়, নিশাত যখন পর্বত শৃঙ্গের কাছাকাছি তখন প্রচণ্ড ঝড়ে তাদের তাঁবু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এ প্রতিকূল অবস্থায় ২ জন শেরপা ফিরে যায়। তার মধ্যেও অদম্য সাহসী নিশাত জীবন বাজি রেখে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় শৃঙ্গে আরোহণ করেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করে লাল সবুজ পতাকা উত্তোলন করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করায় নিশাতকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নিশাত মজুমদার ২০০৩ সাল থেকেই পেশাদার পর্যায়ের পর্বতারোহণে জড়িত। ২০০৩ সালে তিনি বাংলাদেশ এস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এভারেস্ট বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে কেওক্রাডং (৩১৭২ ফুট) চূড়ায় আরোহণ করেছিলেন। ২০০৬ সালে বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে বিএমটিসি আয়োজিত বাংলাদেশের নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে আবারও কেওক্রাডং চূড়ায় ওঠেন তিনি। ২০০৬-এর সেপ্টেম্বরে বিএমটিসি আয়োজিত নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে (১৭,৫০০ ফুট) ওঠেন। ২০০৭-এর মে মাসে বিএমটিসির অর্থায়নে দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে পবর্তারোহণের প্রশিক্ষণ নেন এবং সেপ্টেম্বরে হিমালয়ের মেরা পর্বতশৃঙ্গ (২১,৮৩০ ফুট) বিজয় করেন। পরের বছর থেকে নিশাত এভারেস্ট বিজয়ে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন। যার অংশ হিসেবে ২০০৮-এর মে মাসে হিমালয়ের সিঙ্গুচুলি পর্বতশৃঙ্গে (২১,৩২৮ ফুট) ওঠেন। একই বছর সেপ্টেম্বরে তিনি ভারতের উত্তর কাশ্মীর গঙ্গোত্রী হিমালয়ের গঙ্গোত্রী-১ পর্বতশৃঙ্গে (২১,০০০ ফুট) ওঠেন। এটি ছিল বাংলাদেশ-ভারতের একটি যৌথ অভিযান। পরের বছর এপ্রিলে আরেকটি যৌথ অভিযানে নিশাত বিশ্বের ৫ম উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ মাকালু (২৭,৮৬৫ ফুট) জয় করেন। ২০১১ সালেই তার এভারেস্ট অভিযানে অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার কারণে তা এক বছর বিলম্বিত হয়।
বাবা আবদুল মান্নান মজুমদার এবং মা আশুরা মজুমদারের চার সন্তানের মধ্যে নিশাত দ্বিতীয়। তার জন্ম ১৯৮১ সালে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলায়। নিশাত অবিবাহিত এবং তার চার ভাইবোনের প্রথমজন গৃহিণী, তৃতীয়জন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এবং চতুর্থজন ব্যবসায়ী। নিশাতের বাবা উপজেলার ১০ নং ভাটরা ইউপির দক্ষিণ ভাটরা মজুমদার বাড়ির বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। জন্মের দুই বছর পর থেকেই নিশাত থাকছেন ঢাকায়। মাধ্যমিক পাস করেছেন ফার্মগেটের বটমলী হোম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এবং উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন শহীদ আনোয়ারা গার্লস কলেজ থেকে। নিশাতের আগে ২০১১ সালের ২১ মে দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন এমএ মুহিত, যিনি এবার নিশাতের এভারেস্ট বিজয়ের সময়ের সহযাত্রী হয়েছেন। গড়েছেন দ্বিতীয়বারের মতো এভারেস্ট বিজয়ের এক অনন্য কীর্তি। তার আগে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ২০১০ সালের ২৩ মে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গকে জয় করেন মূসা ইব্রাহীম।