দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ এক আশ্চর্য যাদুঘর। তবে সচরাচর দেখা পাওয়া কোন যাদুঘরের মতো নয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পানির নীচে।
এক আশ্চর্য যাদুঘরের কাহিনী রয়েছে আপনাদের জন্য। সংগৃহিত হলেও কাহিনীগুলো পাঠকদের অনেক অজানা তথ্যের সমাহার হয়ে তাকে আমাদের চিত্র-বিচিত্র বিভাগে। আজ এমনই এক যাদুঘরের কথা তুলে ধরা হচ্ছে। পাঠকরাও পড়তে পড়তে এক সময় চলে যাবেন এক অজানা রহস্যময় দ্বীপে- পানির গভীরে।
এ এক মায়াবি নীল পানির জগত- যার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি মানুষের প্রতিমূর্তি। হাতে হাত ধরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদল নারী-পুরুষ, কেও বা শুয়ে আছে, কেও আবার চালাচ্ছে সাইকেল। কিছু বৃদ্ধ বসে আছে কালো মুখ করে। আবার দাঁড়িয়ে আছে সন্তানসম্ভবা এমন অনেক নারী। টেবিলে রাখা টাইপ মেশিনে টাইপ করে চলেছে অনেকেই, কেও আছে টেবিলে শুয়ে আবার কেও আছে দাঁড়িয়ে।
এভাবেই সাজানো হয়েছে পানির নিচে আশ্চর্য এই জাদুঘর। এই জাদুঘরটির নাম কানকুন মেরিন পার্ক। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১০ মিটার নিচে অবস্থিত এ জাদুঘর যেনো এক মায়াবি ভুবন। এই যাদুঘরে রয়েছে ৪০০ মানুষের প্রতিমূর্তি। এই প্রতিমূর্তিগুলো সাজানো হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। দেখে মনে হয়, পানির নিচে চলমান আলাদা একটি জগত। এই জাদুঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের নানা প্রজাতির মাছ। এই জাদুঘরটি তৈরি করেছেন যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ভাস্কর জেসন দ্য ক্লেয়ার্স টেইলর। এটি তৈরির পিছনে একটি কারণও রয়েছে। এখানে আছে কানকুন ইসলা মুজেরেস ন্যাশনাল মেরিন পার্ক। বছরের সবসময় এই পার্কে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। ফলে সমুদ্র উপকূলে জলজ প্রাণীর আগমন ও জলজ প্রবালের অস্তিত্ব চরম সংকটের মুখে পড়েছিল। মেক্সিকোর পশ্চিম উপকূলে সমুদ্রের নিচের স্বাভাবিক পরিবেশ ছিল না বললেই চলে।
উপকূলের এমন দুর্দিনে কাণ্ডারি হয়ে আবির্ভূত হন ভাস্কর জেসন দ্য ক্লেয়ার্স টেইলর। তিনি চিন্তা করেন, সমুদ্র উপকূলে স্বাভাবিক অবস্থা আবার ফিরিয়ে দিতে হবে। তার চিন্তার কথা জানতে পেরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় মেক্সিকোর দ্য মিউজিও সাব একুয়াটিকো ডি আর্ত নামক একটি সেচ্ছাসেবি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় শুরু হয় একটি প্রকল্প। যার নাম দেওয়া হয় লাইফ কাস্টস।
এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল ভাস্কর্যের মাধ্যমে নতুন করে গড়ে তোলা হবে উপকূলের প্রবাল প্রাচীরগুলো। কানকুন মেরিন পার্ক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাদুঘরটি সাজানো হয় জেসনের তৈরি ভাস্কর্য দিয়ে। অন্যান্য ভাস্কর্যের চেয়ে একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি করা হয় এগুলো। কেননা সমুদ্রের পানির উপরে কখন কতটা আলো পড়ছে তার ওপর নির্ভর করে পানির নিচে ভাস্কর্যের রং বদলে যায়। আর এর ধরনও পানির উপরের ভাস্কর্যের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। ব্রিটিশ শিল্পী জেসন টেইলর তার এই ভাস্কর্যমালার নাম দিয়েছেন ‘দ্য সাইলেন্ট এভোলিউশন’।
এই ভাস্কর্যগুলো তৈরির জন্য জেসন ব্যবহার করেছেন বিশেষ এক ধরনের সিমেন্ট। এই সিমেন্ট সাধারণ সিমেন্টের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী ও প্রবাল-বান্ধব। এ সিমেন্ট দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে যাতে এগুলোতে খুব সহজেই প্রবাল দানা বাঁধতে পারে। শুরুর প্রথম অবস্থায় প্রায় ২০০ ভাস্কর্য স্থাপনের কথা ভেবেছিলেন টেইলর। কিছুদিন পর তার এই ধারণা বদলে যেতে লাগলো। তিনি ভাস্কর্যের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি করার চিন্তা করেন। শেষতক ৪শ’টি ভাস্কর্যে সেজেছে কানকুন মেরিন পার্ক। সমুদ্রের নিচে বিভিন্ন আঙ্গিকে বসানো হয়েছে ভাস্কর্যগুলো। বিশেষ এক ধরনের শক্ত ফাইবার গ্লাসের সাহায্যে মূর্তিগুলো পানির নিচে দাঁড় করানো হয়েছে। সেটিও তৈরি হয়েছে ভাস্কর্যে ব্যবহৃত উপাদানগুলো থেকেই। এগুলো বসানোর জন্য প্রথমে বিশেষ ক্ষমতাধর ড্রিল মেশিন দিয়ে সমুদ্রতল ফুটো করে নেয়া হয়েছিল। তারপর একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ভাস্কর্যগুলোকে।
এর আশপাশে এখন বাহারি রংয়ের মাছ ও জলজ প্রাণী প্রায় সবসময় ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। আর ভাস্কর্যগুলো তৈরি করা হয়েছিল যে লক্ষ্যে সেই লক্ষ্যও পূরণ হতে চলেছে। এর কারণ প্রতিদিন মূর্তিগুলোকে ঘিরে দানা বাঁধছে প্রবাল। ভাস্কর্যগুলো ভেঙে পড়ার আশংকা একেবারেই নেই, এমনকি সেখানে অবাধে সাঁতার কাটাও যায়। তবে ভাস্কর্যগুলোর বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ বা আবহাওয়া। এখানে প্রায়ই হ্যারিকেন ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাণ্ডব চলে থাকে। আর এই তাণ্ডবে যে কোনও মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে স্বপ্নের এই পানির নিচের আশ্চর্য জাদুঘরটি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ভাস্কর্যগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারবে। আর যদি এই ভাস্কর্যগুলো টিকে থাকতে পারে তাহলেই টিকে থাকবে উপকূলের প্রবাল। এমন আশা অন্তত এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা সব সময় করছেন। যে লক্ষ্য নিয়ে পানির নিচের এই আশ্চর্য যাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে- সে উদ্দেশ্য সফল হবে সে প্রত্যাশা সকলের। সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর।