দি ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ বাংলাদেশে হাসপাতাল বিশেষ করে সরকারি হাসপাতাল নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু এবার খোদ রাজধানীর বুকে নামকরা হাসপাতাল বক্ষব্যাধি হাসপাতালের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগে জানা যায়, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসকরা রোগী ধরার ফাঁদ পেতে বসেছেন। হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকলেও বহির্বিভাগে আসা রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে হরহামেশা বাইরের প্যাথলজি কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠাচ্ছেন। বাইরে পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের চেয়ে নেয়া হচ্ছে তিন থেকে চারগুণ বেশি টাকা। এতে মোটা অংকের কমিশন পেয়ে থাকেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। শুধু বাইরে পাঠিয়ে কমিশন নিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না চিকিৎসকরা, প্যাথলজিতে রিপোর্ট দিতে বিলম্ব করিয়ে বিকালে ওই চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখাতে বাধ্য করানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছে রোগীরা। এটি প্রতিদিনের ঘটনা। সরেজমিন বক্ষব্যাধি হাসপাতালে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।
চিকিৎসকদের কক্ষ থেকে রোগী বের হওয়ার সময় হাতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ক্লিনিকের কিংবা প্যাথলজির ভিজিটিং কার্ড। ওই কার্ড নিয়ে যেতে বলা হচ্ছে ওইসব প্রতিষ্ঠানে। এমনই একজন রোগী জোবেদা। ২৮ মে সকালে তিনি টিকিট কেটে চিকিৎসকের কাছে যান। ওই চিকিৎসক তাকে ৪টি পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন এবং রিলায়েন্স মেডিকেল সার্ভিসেসে গিয়ে ওই পরীক্ষাগুলো করানোর কথা বলেন। তিনি যান ওই মেডিকেলে। সেখান থেকে বলা হয়, বিকাল ৪টার আগে রিপোর্ট পাবেন না। বিকালে রিপোর্ট নিয়ে হাসপাতালের ওই চিকিৎসককে প্রাইভেট চেম্বারে দেখানোর পরামর্শ দেয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মচারী বলেন, চিকিৎসকরা এভাবেই হাসপাতাল থেকে রোগী পাঠিয়ে বিকালে চেম্বারে বসে রোগী দেখছেন। বিনিময়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। চিকিৎসকরা বহির্বিভাগে আছেন, চিকিৎসা দেয়ার জন্য নয়, প্যাথলজি ও নিজস্ব চেম্বারে রোগী ধরার জন্য। বহির্বিভাগের চিকিৎসকরা কিভাবে রোগীকে বাইরে যেতে বাধ্য করছেন তা দেখার জন্য সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে রোগী সেজে ২৮ মে একটি টিকিট সংগ্রহ করে ৫ নম্বর কক্ষে চিকিৎসক আখতার হোসেনের কাছে যাওয়া হয়। ৫ নম্বর কক্ষে ঢুকে দেখা যায়, চিকিৎসক আখতার হোসেন আরেক চিকিৎসকের সঙ্গে বদলি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলাপ করছেন। প্রায় ১০ মিনিট পর টিকিটটি হাতে নিয়ে একটি সিল মেরে দিলেন। পিয়ন মোস্তফাকে ওই চিকিৎসক ডেকে বললেন, রাফা মেডিকেল সার্ভিসেসের একটি কার্ড দাও ওর হাতে। এ সময় ওই চিকিৎসকের টেবিলে রাফা মেডিকেল সার্ভিস ছাড়াও আনোয়ারা মেডিকেল সার্ভিসেস, আয়েশা মেমোরিয়াল সার্ভিসেসসহ ৫টি মেডিকেলের কার্ডের বই দেখা যায়। পরীক্ষা শেষে হাসপাতালে কখন আসতে হবে জানতে চাইলে চিকিৎসক বলেন, রিপোর্ট দিতে ৩টা বেজে যাবে। তুমি রাফাতেই বসে থেকো, আমি ৩টার পর ওখানে গিয়ে দেখব। প্রাইভেটভাবে দেখাতে হলে টাকা লাগবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, টাকা ছাড়া কি হবে? বেশি লাগবে না, ৩০০ টাকা দিলেই হবে। এরপর রাফা মেডিকেলে যাওয়া হয়। রিসিপশনে চিকিৎসক আখতার হোসেনের দেয়া কার্ড ও টিকিটটি দেয়া হয়। রিসিপশনে থাকা আবদুল্লাহ জানান এক্সরে, কফ ও রক্ত পরীক্ষা করতে ৮৫০ টাকা লাগবে। তিনি বলেন, ৩টার পর চিকিৎসক আখতার হোসেন এখানে আসবেন, আপনি পরীক্ষা করাতে দিয়ে বসেন। ২২ মে চুয়াডাঙ্গা থেকে বজলুর রহমান শায়ক নামের একজন রোগী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে আসেন। হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক এবং আরপি ডা. বরকত উল্লাহর তার কোন কথা না শুনেই লিখতে শুরু করলেন। লেখা শেষে টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, পরীক্ষা করিয়ে আনতে হবে। ওই ডাক্তারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এমএলএসএস রিলায়েন্স মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেডের একটি ভিজিটিং কার্ড রোগীর হাতে দিয়ে বললেন, এই ঠিকানায় গিয়ে কফ ও রক্ত পরীক্ষা করিয়ে আনেন। তবে বিকাল ৩টার আগে রিপোর্ট দেবে না। আর ৩টার পরে হাসপাতালে চিকিৎসককে পাওয়া যাবে না। মহাখালী ওয়্যারলেস গেটের কাছে ওই চিকিৎসক নিজ চেম্বারে বসবেন। সেখানে রিপোর্ট নিয়ে ৩০০ টাকা ভিজিট দিয়ে দেখাতে হবে। এসব পরীক্ষা হাসপাতালে করা যাবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতালে ৩-৪ দিন সময় লাগবে রিপোর্ট দিতে। তার চেয়ে বাইরে করিয়ে এই চিকিৎসককে প্রাইভেটভাবে দেখাতে পারবেন। এরপর আলম নামের আরেকজন হাসপাতালের কর্মচারী পরিচয় দিয়ে বলেন, ডা. বজলুর রহমান স্যারের প্যাথলজিতে গিয়ে পরীক্ষা করানোই ভালো হবে। হাসপাতালের প্যাথলজিস্ট মোস্তফা কামাল ২টার পরে গিয়ে পরীক্ষার রিপোর্ট দেবে। এরপর তিনি পকেট থেকে ডা. বরকত উল্লাহর একটি ভিজিটিং কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, এখন গিয়ে রক্ত ও কফ দিয়ে ৩টার পর রিপোর্ট নিয়ে স্যারকে ওই চেম্বারেই দেখাতে পারবেন। এ সময় সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে আলমের কাছে জানতে চাওয়া হয়- রিপোর্ট ৩টার পরে কেন? আগে দিলে তো এই রোগী হাসপাতালেই ওই চিকিৎসককে দিয়ে দেখাতে পারেন- এমন প্রশ্নে আলম বলেন, ভাই সবই তো বোঝেন। বুঝে না বোঝার ভান করেন কেন। আগে রিপোর্ট দিলে তো হাসপাতালেই স্যারকে দেখতে হবে। তখন তো স্যারের কাছে ৩০০ টাকা দিয়ে দেখাবেন না। এটাই স্যারের কৌশল। সব স্যারেরই (চিকিৎসক) একই কৌশল। সব প্যাথলজিতেই বলা আছে ৩টার আগে রিপোর্ট না দেয়ার জন্য। এটা রোগী ধরার ফাঁদ। বাইরে পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসকরা মোটা অংকের কমিশন হাতিয়ে নিচ্ছেন।
এভাবেই বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তাররা নিরীহ রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন অর্থ। অথচ হাসপাতালেই বিনা পয়সায় এই সেবা সাধারণ রোগীদের পাওয়ার কথা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।