সরোয়ার আলম ॥ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের আশংকা করছে সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা। ওই সংস্থাটি এমন আভাস দিয়ে বলেছে, গতানুগতিক রাজনীতি ও বিদ্যমান বড় দুটি রাজনৈতিক দলের বাইরে ব্ল–ব্যান্ড কল, সিটিজেন মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস, সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও ইয়থ এনগেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট (ইয়েস)- এই চারটি সংগঠনের সমন্বয়ে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব হতে পারে। ইতিমধ্যে ওইসব সংগঠন সমাবেশ ও সম্মেলন করে রাজনীতির মাঠে প্রবেশের আগাম বার্তা জানিয়ে দিয়েছে। এক সপ্তাহ আগে গোয়েন্দারা একটি রিপোর্ট তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করেছেন। তৃতীয় শক্তি রুখতে গোয়েন্দারা কিছু সুপারিশও করেছেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১১ শুরুর দিকে ‘আরব-বসন্ত’ নামে খ্যাত পুরো আরব বিশ্বে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয় দেশে দেশে এবং নতুন সরকার গঠিত হয়। আরব-বসন্তখ্যাত ওই আন্দোলন সংগঠিত হয় ইন্টারনেট তথা ফেসবুকের মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে বিকল্প ধারার নেতা মাহী বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ইন্টারনেট ও ফেসবুককেন্দ্রিক সংগঠন ব্লু-ব্যান্ড কল। বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক, ড. শাহদিন মালিক ও রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সিটিজেন মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস। পরে নাগরিক ঐক্যের ব্যানারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য নাগরিক আন্দোলনের নামে টিআইবির অনুপ্রেরণায় গঠিত হয় সচেতন নাগরিক কমিটি তথা সনাক ও ইয়থ এনগেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট (ইয়েস), এসব ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফর্মে সংগঠিত হলেও পরোক্ষভাবে বিষয়গুলো একই সূত্রে গাঁথা। তাদের উদ্দেশ্য দুটি বড় রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ নাগরিকদের যে কোন ইস্যুতে একত্রিত করে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি ফ্যাক্টর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। যদিও একই ইস্যুতে বিভিন্ন প্লাটফর্মে একত্রিত হচ্ছেন সমাজের গণ্যমান্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং প্রভাবশালী গ্রুপ। কিন্তু এসব প্লাটফর্মে একত্রিত হওয়া ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন। সব বড় রাজনৈতিক দল থেকে বিভিন্ন সময় বের হয়ে ছোট ছোট দল গঠন করা, দল থেকে বহিষ্কৃত, দলে নানা কারণে নিষ্ক্রিয় বা দলে কোণঠাসা হয়ে পড়া নেতাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে এসব প্লাটফর্মে একত্রিত হচ্ছেন বা তৃতীয় শক্তির উত্থান কামনা করছেন। সেনা সমর্থিত দীর্ঘমেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সমর্থনকারী বিভিন্ন ব্যক্তি বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে আবারও তারা তৃতীয় শক্তির উত্থান চাচ্ছেন। নীতি ও আদর্শবান কিছু রাজনীতিক সুখী-সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তৃতীয় শক্তির উত্থানকে স্বাগত জানাচ্ছেন। নানা দৃষ্টিভঙ্গির রাজনৈতিক নেতারা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফর্মে অবস্থান করে চলমান দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে একটি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা করছেন।
গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত বছরের শুরুর দিকে মাহী বি. চৌধুরী ও ড. শাহদীন মালিক ইন্টারনেট ও ফেসবুককেন্দ্রিক সংগঠন ব্ল–ব্যান্ড কল গড়ে তোলেন। একই বছরের ২২ ও ২৩ মার্চ তারা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আইন-শৃংখলা বাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে ব্লু-ব্যান্ড কল ভালোভাবে সংগঠিত হতে পারেনি এবং সরকার পতনে কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। গত বছরের ২৮ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বর্ষীয়ান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক ও আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে সিটিজেন মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। চলতি বছরের ১ জুন ওই সংগঠনের ব্যানারে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমাবেশে ঘোষণা করা হয়, আগামী তিন মাসের মধ্যে নাগরিক আন্দোলন নামে একটি কমিটি ঘোষণা করা হবে এবং তৃতীয় শক্তির রাজনৈতিক প্লাটফর্ম যাত্রা শুরু করবে। একই দিন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে টিআইবির অনুপ্রেরণায় সনাক ও ইয়েস-এর দু’দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে দেশের ৪৫টি অঞ্চলের ২৭৫০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। দু’দিনের সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, হাফিজ উদ্দিন, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারকে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। ভিন্ন রাজনৈতিক মেরুকরণ বা পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে প্রত্যাশী সৎ রাজনৈতিক নেতারা রাজনৈতিক সংলাপ, পলিসি ডায়ালগ, মতবিনিময়, রাজনৈতিক পর্যালোচনাসহ যে কোন আঙ্গিকে আলোচনায় বসে তাদের অভিযোগ ও পরামর্শ গ্রহণ করে সরকারকে গঠনমূলক পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। সৎ ও আদর্শবান গণ্যমান্য ব্যক্তি ও রাজনীতিকদের উত্থাপিত সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের ওইসব প্লাটফর্ম নিষ্ক্রিয় করে দলছুট রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তির উত্থানে সচেষ্ট ব্যক্তিদের শক্তিহীন করে দেয়া যেতে পারে। সরকার দলীয় বহিষ্কৃত, নিষ্ক্রিয় ও কোণঠাসা নেতৃবৃন্দকে দলের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কম-বেশি অংশগ্রহণ করিয়ে তাদেরও তৃতীয় শক্তির উত্থানের প্রক্রিয়া থেকে বিরত রাখা যেতে পারে। তৃতীয় শক্তির উত্থানে স্বাগত জানানো সদ্য গঠিত প্লাটফর্মের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের যোগাযোগ, বিভিন্ন বিদেশী মিশনের কূটনীতিকদের সঙ্গে কিংবা অন্য কোন বিদেশীর সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় কি না এ ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। (সৌজন্যেঃ দৈনিক যুগান্তর)